রোমুলাস ও রেমুস ব্রোঞ্জমূর্তি (৫০০-৪৮০ খ্রি.পূ.)

রোমক সভ্যতার ইতিহাস বলতে গেলে বলতে হবে প্রায় সাড়ে বাইশ শত বছর আগের কথা। ভূ-মধ্য সাগরের উত্তরের তীর ঘেঁষে ছোট একটি শহর গড়ে উঠেছিল। নাম রোম। এই রোম শহরকে এক সময় ‘বিশ্বের রাজধানী’ বলা হতো। অনেকে একে বিশ্বের প্রথম রাজকীয় শহর, প্রথম মেট্রোপলিটন শহরও বলে থাকে। এই শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল রোমক রাজ্য, রোমক গণপ্রজাতন্ত্র ও অবশেষে রোমক সাম্রাজ্য। 

রোমকরা গ্রিক ভাষার অনুকরণে নিজেদের বর্ণমালা ও লেখ্য ভাষা সমৃদ্ধ করেছিল। এই ভাষা লাতিন নামে পরিচিত।  ভার্জিল (Virgil), হোরেস (Horace), প্রপারতিউস (Propertius)- এরা ছিল লাতিনের বিখ্যাত সব প্রাচীন কবি। এদের নাম বললে আরও এক জন প্রাচীন কবির কথা মনে পড়ে- টিবুলাস (Tibullus) (সময়কাল ৫৫-১৯ খ্রি.পূ.)। তার কবিতার দুই বিখ্যাত নারী চরিত্র- দেলিয়া (Delia) ও নেমেসিস (Nemesis) পরবর্তীকালে অনেক সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কবি রোমকে Urbs Aeterna বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ল্যাটিন ভাষা জন্ম নেয়া ইটালিয় ভাষায় এ শব্দগুচ্ছ অনুবাদ করলে দাড়ায় ‘লা সিটা এতারনা’ (La Città Eterna) । বাংলায় বললে ’চিরন্তন শহর’।

রোম এখন ইতালির রাজধানী। ইতালিয় ভাষায় ইতালি হলো ইতালিয়া (Italia)। ইতালিয়া শব্দটির মূল শব্দ vitalia। এর অর্থ ‘গো-মহিষের দেশ’ (land of cattle)। ইতালি নামের বুৎপত্তি নিয়ে গ্রিক পুরাণে গল্পও আছে। জারিয়ান (Geryon) নামে প্রচণ্ড প্রতাপশালী এক দৈত্য ছিল। সে গো-মহিষ পালন করতো। তার কোন গরু-মহিষগুলোকে হস্তগত করা ছিল দুঃসাধ্য। রাজা উরিসথেউস (Eurystheus) হারকিউলিসকে (Heracles) সেগুলো চুরি করতে বলে।  এগুলো নিয়ে হারকিউলিস পালানোর সময় এতটা ষাড় দলছুট হয়ে যায়। এটা সাঁতরে ইতালির দ্বীপ সিসিলিতে চলে যায়। আঞ্চলিক ভাষায় ষাড়কে বলা হয় ‘ইতালস’ (italos)। এটা থেকে ইতালি।

রোম শহরের গোড়াপত্তন

রোমের উত্তরে ইত্রুসকান (বর্তমান ইতালির ইত্রুরিয়া অঞ্চলের আদবাসী) ও দক্ষিণে ছিল গ্রিকরা। এই জাতিগুলো তখন যথেষ্ট উন্নত ছিল। এদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য হতো। এই বাণিজ্যের পথিমধ্যে ছিল রোম। শহরটি ছিল ইত্রুসকান ও গ্রিকদের থেকে বিতাড়িত সব চোর-বদমাশদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এদেরকে নিয়েই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে রোম।

রোমকদের বিশ্বাস, তারা ট্রোজান যুদ্ধ (১২৬০-১১৮০ খ্রি.পূ.) থেকে বেঁচে গিয়ে রোমে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের বংশধর। তাদের জন্ম ইতিহাসের সাথে দুটি নাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে- রোমুলাস ও রিমাসের ।  বিখ্যাত ট্রোজান যোদ্ধা ইনিয়াসের বংশে এ যমজ জন্ম লাভ করে। ইনিয়াসকে নিয়ে ভার্জিলের মহাকাব্যের নাম ‘ইনিড’।

ট্রয় রাজ পরিবারের অ্যাংকাইসিস ও গ্রিক দেবী অ্যাফোদিতির (রোমক পুরাণে ভেনাস) (পড়ুনডেলফির ওরাকল- সত্য না কি পৌরাণিক গল্প?) সন্তান এই ইনিয়াস। তার ঔরসে ক্রেউসা বা লাভিনিয়ার গর্ভে জন্মে পুত্র এসকেনিয়াস

রোমের ১২ মাইল দক্ষিণ-পূর্বের এক প্রাচীন শহর আলবা লঙ্গা।  খ্রি.পূ. ১১৫০ সালের দিকে এই শহরের গোড়াপত্তন ঘটেছিল। এসকেনিয়াস ছিল সেই আলবা লঙ্গার প্রথম কিংবদন্তী রাজা। বংশ পরম্পরায় এ বংশের রাজা হয় প্রকাস। তার দুই পুত্র- নুমিতরআমুলিয়াস। বড় ভাই হিসেবে নুমিতর রাজা হলেও আমুলিয়াস তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

তবে তার ভয় ছিল নুমিতরের কন্যা রিয়া সিলভিয়াকে নিয়ে। যদি রিয়া কখনো মা হয়, তবে সে কোন না কোন দিন সিংহাসনে ভাগ বসাবে। তাই সে রিয়ার উপর নজর রাখতে রোমক গৃহ দেবী ভেসতাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। তবে ঘটনা ঘটে যায় অন্য ভাবে। রোমক দেবতা মার্সের (গ্রিক যুদ্ধ দেবতা এরেস) (পড়ুন-গ্রিক পুরাণের সহজপাঠ: তিতান দেব-দেবীগণ (২য় ভাগ) ধর্ষণে রিয়ার গর্ভে জন্ম নেয় রোমুলাস ও রেমুস। এই দেবতার নামে মঙ্গল গ্রহ নামকরণ করা হয়েছে।

রোমুলাস ও রেমুসকে টাইবার নদীর তীরে ফেলে দেয়া হয়। তারা সেখানে নেকড়ের দুধ খেয়ে বেঁচে ছিল। মেষপালক ফস্টুলাস তাদেরকে কুড়িয়ে পায়, লালনপালন করে। এক সময় রোমুলাস ও রেমুস নানা নুমিতরকেও খুঁজে পায়। আলবা লঙ্গা ফিরে আসে নুমিতরের হাতে।  

কোথায় গড়ে তুলবে তাদের নতুন শহর- প্যালাটাইন পাহাড়, না কি এভেনটাইন পাহাড়ে? এই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রোমুলাস রেমুসকে হত্যা করে ভাইয়ের স্মৃতিতে প্যালাটাইন পাহাড়ের নতুন এ শহরের নাম রাখে রোম। এ দুটি পাহাড় বাদেও রোমে আরো পাঁচটি পাহাড় আছে। এ সাতটি পাহাড়ের জন্য রোমকে ‘সাত পাহাড়ের শহর’ বলে।

সাত রাজার রোম শাসন (৭৫৩-৫০৯ খ্রি.পূ.)

রোমের প্রথম রাজা রোমুলাস। তার নতুন শহরে পুরুষেরা ভীড় করলেও নারীরা আসতে চাইছিল না। তাই সে কিউরেস শহরের স্যাবাইন নামের গোত্রের নারীদেরকে অপহরণ করে সেখানে নিয়ে আসতে শুরু করে। এ নিয়ে স্যাবাইন রাজা তাতিয়াসের সাথে রোমুলাসের সংঘাত শুরু হয়। এক সময় এ দু’জনের মধ্যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল। রোমুলাসের স্যাবাইন নারী অপহরণের ঘটনাকে আশ্রয় করে অনেক শিল্পকর্ম রয়েছে। এর মধ্যে ইতালিয় শিল্পী জামবোলোইয়ার ভাস্কর্য ‘রেইপ অভ স্যাবাইন উইমেন’ (১৫৭৪-৮২) বিখ্যাত।

রোমুলাসের পরে স্যাবাইন গোত্র হতে রোমের রাজা হয় নুমা পম্পিলিয়াস। তিনি রোমুলাসের মতো দাঙ্গাবাজ ছিলেন না। তিনি রাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। তিনি ভেসতাল ভার্জিনদেরকে রোমে নিয়ে আসেন। সেকালের রোমে যে সব নারী পুরোহিতরা দেবী ভেসতার (গ্রিক দেবী হেস্তিয়া) ব্রত নিয়ে সারা জীবন কুমারী থাকতো, তাদেরকে ভেসতাল ভার্জিন বলা হতো। নুমা রোমে ধর্মীয় কলেজ ও দ্বার দেবতা জানুসের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই জানুসের নাম থেকে ইংরেজি পঞ্জিকায় ‘জানুয়ারি’ মাসের নাম রাখা হয়েছে।  

তৃতীয় রাজার নাম তুলুস হোস্তিলিয়াস। তিনি ‘কুরিয়া হস্তিলিয়া’ নামে রোমে একটি সিনেট ভবন তৈরি করেন। চতুর্থ রাজা এংকুস মারতিউস ছিল নুমার নাতি। তিনি বন্দর নগরী ওসতিয়ার গোড়াপত্তন করেন।

রোমের পঞ্চম রাজা ছিল একজন ইত্রুসকান- তার্কিনিয়াস প্রিসকাস। তার্কিনের আমলে আশেপাশের অঞ্চলে রোমের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। তিনি রথের চালানোর প্রতিযোগিতা ‘রোমক সার্কাস খেলা’র প্রচলন করেন। সম্ভবত তিনি জুপিটারের মন্দিরও তৈরি করেন। জুপিটার হলো গ্রিক দেবতা জিউস। জুপিটারের নাম বৃহস্পতি গ্রহের নাম রাখা রয়েছে।

তার্কিনের পরে তার জামাতা সার্ভিউস তুলিয়াস রোমের রাজা হয়। তিনি রোমে প্রথম জনসংখ্যা গণনার কাজ শুরু করেন। তুলিয়াসকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে শেষ রোমক রাজা তার্কিনের পুত্র/নাতি তার্কিনিয়াস সুপারবাস। সাতজন রোমক রাজার মধ্যে একেই স্বৈরাচারী বলা হয়।

এক সম্ভ্রান্ত কর্তাব্যক্তির (prefect) কন্যা ও এক গভর্নরের স্ত্রী লুক্রেশিয়া নামে এক নারীর সাথে তার্কিনের পুত্রের এক যৌন কেলেঙ্কারী ও জনসম্মুখে লুক্রেশিয়ার আত্মহত্যা তার্কিনের রাজত্বের সর্বনাশ ঘটায়। তার্কিনকে জনগণ রাজ্য থেকে বের করে দেয়। ‘লুক্রেশিয়া ধর্ষণ’ এ ঘটনাকে অসংখ্য চিত্রকর্ম রয়েছে। এর মধ্যে তিতিয়ানের ‘তার্কিন ও লুক্রেশিয়া’ (১৫৭১) উল্লেখযোগ্য।

তার্কিনের ঘটনার পরে রোমকরা রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে রোমের শাসন ব্যবস্থায় দুই জন্য কনসুল (Consul) নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই কনসুলরা ৩০০ সিনেটের সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। এই সিনেটের সদস্যদের ‘প্যাট্রিসি’ (patres হতে লাতিনে patricii, ইংরেজিতে patricians; অর্থ fathers) বলা হতো। রোমকদের এ শাসন ব্যবস্থা S.P.Q.R নামে পরিচিত ছিল। S.P.Q.R বলতে Senātus Populusque Rōmānus বোঝায়। এর অর্থ ‘রোমক সিনেট ও জনগণ’। এভাবে শুরু হয় রোমক ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়- রোমক গণপ্রজাতন্ত্র।

(ধারাবাহিকভাবে পৃথিবীর গল্প চলবে)

পৃথিবীর গল্প পরম্পরা