সম্রাট হাম্মুরাবি

মেসোপটেমিয়া- আসেরীয়-ব্যাবিলনীয়-হিটাইট-ক্যাসাইট-নব্য আসেরীয়- নব্য ব্যবিলনীয়

ব্যাবিলন-আসেরীয়-মিটানি-হিটাইট শাসনের ম্যাপ
ব্যাবিলন-আসেরীয়-মিটানি-হিটাইট শাসনের ম্যাপ

আসেরীয় সাম্রাজ্য

মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের দক্ষিণে ছিল সুমের অঞ্চল। সুমেরের উত্তরে ছিল আকেদ শহর। আকেদের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে গড়ে ওঠে আরেকটি শহর। বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত এ শহরের নাম ছিল আসুর। এই শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আসেরীয় সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যের অনেক শাসকেরা আকেদীয় সাম্রাজ্যের শাসকের নামে নামকরণ করতো।

সুমেরীয় সভ্যতার কাছাকাছি সময় থেকে আসেরীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটলেও খ্রিঃ পূঃ ১৮ শতক পর্যন্ত এ অঞ্চলে খ্যাতনামা কোন শাসকের নাম পাওয়া যায় না। এ শতকের শেষে এ অঞ্চলের এক শাসক নিজেকে ‘মহাবিশ্বের রাজা’ দাবী করে। এ শাসকের নাম ছিল শামসী আহাদ (১ম) (১৮১৩-১৭৮১ খ্রি.পূ.)। আহাদের ২৫০ বছর পরেও আসেরীয় সাম্রাজ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন শাসকের আগমন ঘটেনি।

মিটানি শাসন

ফলে খ্রিঃ পূঃ ১৪ শতকের শেষের দিকে এ অঞ্চলের ক্ষমতা মিটানি (হুরি বা হ্যানিগালব্যাট) নামের এ জাতির হাতে চলে যায়। বর্তমান সিরিয়ার উত্তরে ও তুরস্কের দক্ষিণ পূর্ব দিকে মিটানিরা বাস করতো। হিটাইটরা যখন ব্যাবিলনে আক্রমণ করে সে সময়ে মিটানিরা আসুর অঞ্চলের আধিপত্য বিস্তার করে। তবে মিটানিদের শাসনকালে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য কোন শাসক পাওয়া যায না।

ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য

আকেদীয় সাম্রাজ্যের অবসান ও সুমেরীয়দের পুনর্জাগরণের শেষ বিখ্যাত শাসক উর-নাম্মুর পরে প্রায় আড়াইশো বছরে মেসোপটেমিয়ায় উল্লেখ করার মতো তেমন কোন বিখ্যাত শাসক নেই। তবে খ্রিঃ পূঃ ১৭ শতকের শুরুতে সুমের অঞ্চলের উত্তরে আকেদ শহরের দক্ষিণে ব্যাবিলন নামের এক শহরকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী এক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এই সাম্রাজ্য ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। মেসোপটেমিয়ার পশ্চিম অঞ্চলের এখনকার সিরিয়ার এমোরাইট জাতি গোষ্ঠীরা এ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।

ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের প্রথম বিখ্যাত সম্রাটের নাম হামুরাবি। শামসী আহাদের মৃত্যুর পরে আসুরও তার আওতায় চলে আসে। উর-নাম্মুর মতো হামুরাবি আইন সংকলনের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ সংকলন ‘হামুরাবির কোড’ নামে পরিচিত। ১৯০১ সালে এলামিদের প্রাচীন রাজধানী সুসা থেকে আবিস্কৃত হয় অমূল্য এই সংকলন। মোট ১২টি পাথরের টুকরোয় খোদাই করে লেখা ২৮২টি আইনের এই সংকলন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন লিখিত আইন সংকলন হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

‘হামুরাবির কোড’ এ বাণিজ্য, বিবাহ, দাসত্ব, কর্জ ও চৌর্য – সব কিছুই স্থান পেয়েছিল। শাস্তির যে সব বিধান সেখানে ছিল, আজকের যুগে সেগুলি বর্বর মনে হতে পারে; যেমন-চুরির অপরাধে আঙুল কেটে নেওয়া, বিবাহিত নারীকে কোনও পরপুরুষ চুম্বন করলে তাঁর ঠোঁট কেটে ফেলা,অপবাদ প্রচারের শাস্তি হল জিভ কেটে নেওয়া, বাড়ি ভেঙে পড়ে বাড়ির মালিকের পুত্রের মৃত্যু হলে গৃহনির্মাতার পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ইত্যাদি। সংকলটির ১৯৬ নম্বর আইনটিতে ছিল খুবই প্রতিশোধমূলক- “চোখের বিনিময়ে চোখ, দাতের বিনিময়ে দাঁত”।

ব্যাবিলনীয়দের প্রধান দেবতার নাম ছিল মারদুক। এ দেবতাকে নিয়ে রচিত হয় ব্যাবিলনীয়দের অন্যতম সাহিত্য ‘এনুমা এলিস’। এটি প্রায় হাজার খানেক লাইনে লেখা একটি কবিতা। পৃথিবী সৃষ্টি নিয়ে ব্যাবিলনীয়দের বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে এ সাহিত্য রচিত হয়। সুমেরীয়দের প্লেগ রোগের দেবতা নারগিল ছিল ব্যাবিলনীয়দের পাতালের দেবতা। অন্যদের মধ্যে সমুদ্র দেবী তিয়ামাত উল্লেখযোগ্য। 

হিটাইট আক্রমণ

হিটাইটরা ছিলো মেসোপটেমিয়ার সবচে উত্তরের অঞ্চল আনাতোলিয়ার অধিবাসী। আনাতোলিয়া এখন তুরস্ক নামে পরিচিত। খ্রিঃ পূঃ ১৫ শতকের শেষ ভাগে হিটাইটরা এ অঞ্চলে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। এ জাতি ছিলো যোদ্ধা জাতি। আশেপাশের সব অঞ্চলের সাথে হিটাইটদের যুদ্ধ লেগে থাকতো। খ্রিঃ পূঃ ১৭৫০ সালে হামুরাবির মৃত্যু হয়। এর পরের দেড়শো বছরে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে। ফলে খ্রিঃ পূঃ ১৫৮৫ সালে হিটাইটরা ব্যাবিলন শহর লুটপাট করে। এ লুটপাটে নেতৃত্ব দেয় হিটাইট রাজা ১ম মুরসিলি। তবে হিটাইটরা ব্যাবিলনে কোন শাসন গড়ে তোলেনি।

ক্যাসাইট শাসন

হিটাইটরা ব্যাবিলন ত্যাগ করলে মেসোপটেমিয়ার পূর্ব দিকের জাগরোস পর্বতমালা অঞ্চলের এক জনগোষ্ঠী এখানে বসবাস শুরু করে। এ জাতি গোষ্ঠীকে বলে ক্যাসাইট। এ জাতি প্রায় চারশো বছর ব্যাবিলন দখল করে রাখে; কিন্তু ক্যাসাইট শাসনামলে খুব নামজাদা কোন শাসক পাওয়া যায় না। 

নব্য আসেরীয় সাম্রাজ্য

খ্রিঃ পূঃ ১৩ শতকের শেষ দিকে (১২২৫) ব্যাবিলনের ক্যাসাইটরা দক্ষিণের এলামাইট ও উত্তরের আসেরীয়দের পুনুরুত্থানের ফলে রাজ্য হারাতে থাকে। এলামাইটরা ছিল মেসোপটেমিয়ার সুমের অঞ্চলের আরো দক্ষিণে পারস্য উপসাগরের উত্তরে এলাম নামের এক অঞ্চলের আদিবাসী। এলাম বর্তমান ইরানের অন্তর্গত একটি অঞ্চল।

অন্যদিকে, উত্তরের আসেরীয় অঞ্চলে সে সময়ে এক বিখ্যাত শাসকের আবির্ভাব ঘটে। এ রাজার নাম টিগলাথ পাইলিজার (১ম)। সে পুনরায় আসুর, ব্যাবিলন ও সুমের অঞ্চল জুড়ে আসেরীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করে। এ সাম্রাজ্য ৫০০ বছর টিকে ছিল।

এ সাম্রাজ্যের আরো দুই জন শাসকের কথা না জানলে চলে না। এদের এক জন সিনহারিব (৭০৫-৬৮১ খ্রিঃ পূঃ.) এবং অন্য জনের নাম আসুরবানিপাল। সিনহারিব ইসরাইল-প্যালেসটাইন পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করে এবং নিনেভা শহরে আসেরীয়দের রাজধানী গড়ে তোলে। আসুরবানিপাল ইরানের এলামাইটদের দমন করে এবং নিনেভাতে বিশাল এক লাইব্রেরি স্থাপন করে। এটা পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরি। এখানে কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লেখা ২২০০ টি কাদামাটির শ্লেট পাওয়া যায়। আসুরবানিপালের মৃত্যুর পরে আবার আসেরীয় সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে থাকে।

আসেরীয়দের প্রধান দেবতার নাম ছিল আসুর। সে ছিল যুদ্ধ দেবতা। সুমেরীয়দের প্রেমের দেবী ইশতার ছিল আসুরের স্ত্রী। ব্যাবিলনয়দের মারদুক ও আসেরীয়দের আসুর বাদে সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয় ও আসুরীয়দের দেব-দেবীর নাম ও কাজের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই।

নব্য ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্য

আসুরবানিপালের মৃত্যুর পরে ক্ষয়িষ্ণু আসেরীয় সভ্যতার সুযোগে ব্যাবিলন সাম্রাজ্য আবার জেগে ওঠে। যে লোকটি আবার ব্যাবিলনদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনে তার নাম নবোপোলাসার। আবার শুরু হয় ব্যাবিলন সাম্রাজ্য। তার পরে এ সাম্রাজ্যের সবচে বিখ্যাত ব্যক্তি হলো নেবুচাঁদনেজার (২য়)। তিনি ছিলেন স্থাপত্য ও শিল্পের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী। তার বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্প ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান বা ঝুলন্ত বাগান। এটা বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং বিস্ময়কর ফুলের বাগান। এই ঝুলন্ত বাগান গড়ে তোলার পিছনে তাঁকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তার প্রিয়তম সম্রাজ্ঞী। ৪০০০ শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে এই বাগান তৈরি করেছিল। বাগান পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ছিল ১০৫০ জন মালী। ৫ থেকে ৬ হাজার প্রকার ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছিল এই ঝুলন্ত বাগানে। ৮০ ফুট উচুতে অবস্থিত বাগানের সুউচ্চ ধাপগুলোতে নদী থেকে পানি উঠানো হত মোটা পেচানো নলের সাহায্যে।

নেবুচাদনেজারের কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় তিনি ৫৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জেরুজালেম ধ্বংস করেন এবং ইহুদীদের বন্দী করে ৫৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত আটকে রাখেন। ইতিহাসে এটি ‘ব্যাবিলনীয় বন্দী দশা’ নামে পরিচিত। বাইবেলের বুক অব দানিয়েলে এ বর্ণনা পাওয়া যায়। 

নেবুচাঁদনেজারের শাসনামল ক্যালডীয় সভ্যতা নামে পরিচিত। এ সময়ে সপ্তাহকে সাত দিন এবং  দিনরাত্রিকে ২৪ ঘন্টায় ভাগ করা হয়। এ যুগে জ্যোতির্বিদগণ ১২টি নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পান এবং এ থেকে ১২টি রাশিচক্রের সৃষ্টি হয়।

নেবুচাঁদনেজারের হাত ধরে শেষ বারের মতো জেগে ওঠা ব্যাবিলন সাম্রাজ্য পতন ঘটে পারস্য সভ্যতার হাতে। তার মৃত্যুর পরে দূর্বল হয়ে পড়ে ব্যাবিলন সাম্রাজ্য। এ সুযোগে প্রথমে পারস্য সম্রাট মহান সাইরাস (বা সাইরাস ২য়) ব্যাবিলনকে করায়ত্ত্ব করে। এই সাইরাস ২য় জেরুজালেম দখল পুনর্গঠন করে।

(ধারাবাহিকভাবে পৃথিবীর গল্প চলবে)