চীনা সভ্যতার ইতিহাসে শিয়া ও শাং রাজবংশ
চীনা রূপকথা ও লোককাহিনীর তিন কিংবদন্তী ও পাঁচ সম্রাটের পরে প্রায় এগারো শত বছর (২০৭০-১০৪৬ খ্রিঃপূঃ) ধরে দুটি রাজবংশ চীন শাসন করে। এদের একটি শিয়া রাজবংশ, অন্যটি শাং রাজবংশ। শিয়া রাজবংশ পাঁচশো আর শাং রাজবংশ ছয়শো বছর ক্ষমতায় ছিলো।
পাঁচশো বছরের শিয়া (Xia) রাজবংশ (২০৭০–১৬০০ খ্রিঃপূঃ) ও ‘বিধির বিধান’
চৈনিক সভ্যতার ইতিহাসের সাথে হোয়াংহো নদীর বন্যা ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বছর পর বছর এ নদীর বন্যায় চীনাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হতো। সম্রাট ইয়াওয়ের (পাঁচ কিংবদন্তী সম্রাটের চতুর্থ জন) অনুরোধে গুং (Gun) নামে এক ব্যক্তি বন্যা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন। নয় বছর ধরে বিভিন্ন রকমের বাঁধ নির্মাণ করেও গুং এ সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এ সময়কালে সম্রাট শুং (পাঁচ কিংবদন্তী সম্রাটের পঞ্চম জন) চীনের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। শুং ক্ষমতায় এসে গুংয়ের পুত্র দা ইউকে (Da Yu) বন্যা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রদান করেন। পিতার মতো বাঁধ নির্মাণ না করে তিনি সেচনালা ও নদী খনন করে বন্যার পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। এ কাজে ইউ এতটাই আত্মনিয়োগ করেছিলেন যে খাল খননের তের বছর তিনি পরিবারের সাথে দেখা পর্যন্ত করেননি। মহতী এ উদ্যোগের জন্য তাঁকে ‘পানি নিয়ন্ত্রক মহান ইউ’ বলা হয়। শুং ইউকে সেনাপতির পদে নিয়োগ দেন। সেনাপতি হিসেবে ইউ দুর্ধষ চীনা উপজাতি সাংমাইয়াওদেরকে (Sanmaio) দমন করেন। ইউয়ের কার্যক্রমে সম্রাট শুং এতটাই সন্তুষ্ট ছিলেন যে তিনি ইউকে তাঁর পরবর্তী সম্রাট হিসেবে ক্ষমতায় বসান। দা ইউ চীনাদের ইতিহাসে যে রাজবংশের সূচনা করে তা শিয়া রাজবংশ নামে পরিচিত।
চীনারা বিশ্বাস করতো যে বিধাতা রাজাদেরকে রাজ্য শাসনের ক্ষমতা দেন আর রাজাদের দায়িত্ব বিধাতা প্রদত্ত সেই ক্ষমতানুযায়ি রাজ্য শাসন করা। একে তারা বলতো ‘বিধির বিধান’ (Mandate of Heaven)। যদি কোনো রাজা এ নিয়ম লঙ্ঘন করে তবে তার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার থাকে না। শিয়া রাজবংশের শাসনামলে এ ধারণার উদ্ভব ঘটে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিধির বিধান চীনাদের বিপ্লবের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
ইউয়ের পরে শিয়া রাজবংশের আরো ষোল জন সম্রাট চীনাদের শাসন করে। সম্রাট যিয়া (Jia) এ বংশের শেষ সম্রাট। স্বৈরশাসক যিয়া চীনাদের কল্যাণের কথা ভুলে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন শুরু করে। ফলে বিধির বিধানে যিয়া চীনাদের শাসনের অধিকার হারায়। সম্রাট দিকুর (পাঁচ কিংবদন্তী সম্রাটের তৃতীয় জন) দ্বিতীয় স্ত্রী জিয়ানদির পুত্র কিয়ের বংশে জন্ম নেয় ত্যাং (Tang)। এই ত্যাংয়ের নেতৃত্বে চীনারা মিংতিয়াওয়ের যুদ্ধে (Battle of Mingtiao) যিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করলো। সম্রাট ত্যাং ক্ষমতায় এসে শাং রাজবংশের পত্তন করে।
ছয়শো বছরের শাং (Shang) রাজবংশ (১৬০০-১০৪৬ খ্রিঃ পূঃ) ও ‘দৈবলিপির হাড়’
খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে চীনা সভ্যতার হাল ধরে শাং রাজারা। এ সময়ে চীনাদের লিখন পদ্ধতি চালু হয়। তখন তারা বিভিন্ন পশুপাখির হাড়, কচ্ছপের খোলস ইত্যাদির উপর বিভিন্ন বিষয়ে ভবিষ্যৎ বাণী লিখে রাখত। সন্তানাদির লিঙ্গ নির্ধারণ, যুদ্ধ জয়, আবহাওয়া, ফসলাদির উৎপাদন, দেবতাদের প্রতি উৎসর্গ ইত্যাদি বিষয়ে এ সব ভবিষ্যৎ বাণীগুলো লেখা হতো। ভবিষ্যৎ বাণী লেখা এ সব হাড়খণ্ডগুলোকে ‘ওরাকল বোন স্ক্রিপ্ট’ (oracle bone script) বা ‘দৈবলিপির হাড়’ বলে। (পড়ুন– ডেলফির ওরাকল- সত্য না কি পৌরাণিক গল্প?)
চীনাদের লিখন পদ্ধতি ছবিভিত্তিক। এ পদ্ধতিতে সাংকেতিকভাবে তারা মনের ভাব ছবির মতো করে এঁকে রাখতো। তাই এ ধরণের লেখাকে বলা হয় ‘পিকটোগ্রাম’ বা চিত্রলিপি। খ্রিস্টপূর্ব একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পিকটোগ্রাম পদ্ধতিতে ঐ সকল দৈবলিপির হাড়গুলো লেখা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
শাং যুগে চীনে ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু হয়। মিশরীয়দের মতো সে সময়কার চীনা রাজাদেরকেও ব্রোঞ্জের বিভিন্ন তৈজসপত্র যেমন পানিপাত্র, সুরাপাত্র, কুঠার, জেড (jade) পাথর ইত্যাদিসহ সমাহিত করা হতো যা পরবর্তীকালে খনন কার্যের মাধ্যমে আবিস্কৃত হয়ছে। শাং আমলের অন্যান্য আবিস্কারের মধ্যে রয়েছে ঘোড়া-টানা রথ ও কাঠ, হাড় বা শিং দিয়ে তৈরি শাং তীর। সেকালে শাংরা এ সব রথে চড়ে তীর দিয়ে যুদ্ধ করতো, প্রমোদবিনোদনে শিকার করতো। শাং আমলে মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন গ্রীস ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে এখানকার লোকেরা বাণিজ্য শুরু করেছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ১০৪৬ সালে শাং বংশের ক্ষমতায় আসে দি সিং (Di Xin)। শিয়া রাজবংশের যিয়ার মতো সিং অন্যায়-অত্যাচার, জুয়া ও মদ্যপানে ব্যাপক অপব্যয় করে ‘বিধির বিধান’ লঙ্ঘন করতে শুরু করে। দি সিংয়ের এই আচরণের পেছনে তার প্রেয়সী দাজী (Daji) এর চক্রান্তু ছিলো। দোজীর প্ররোচণায় সে প্রজাদের অত্যাচার করতো। ধীরে ধীরে এভাবে সি সিং প্রজাদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।
দি সিংয়ের শাসনামলে ঝৌ নামে একটি গোত্র ছিল। এ গোত্রের প্রধান ছিল ওয়েন (Wen)। সে ছিল শাং রাজবংশের এক সামন্তপ্রভূ (vassal)। ঝৌ গোত্র প্রধান এই ওয়েনের সন্তান উ (Wu)। এই উ এর নেতৃত্বে চীনারা ‘বিধির বিধান’ লঙ্ঘনকারী দি সিংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সিংয়ের অত্যাচারে অতিষ্ট শাং সেনারাও ‘মু’ (Battle of Mu) নামের এ যুদ্ধে উ-কেই সমর্থন করেছিল।
এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চীনে ঝৌ (Zhou) রাজবংশের উত্থান ঘটে। রাজা উ হলেন ঝৌ রাজবংশের প্রথম রাজা।
(ধারাবাহিকভাবে পৃথিবীর গল্প চলবে)
- পর্ব-০১: পৃথিবীর গল্প: চীনা রূপকথা ও লোককাহিনী- উদ্ভব, সংস্কৃতি ও সভ্যতা (তিন কিংবদন্তী ও পাঁচ সম্রাট)
- পর্ব-০২: পৃথিবীর গল্প: চার সভ্যতার লীলাভূমি মেসোপটেমিয়া (সুমেরীয়-আকেদীয়-গুটি-সুমেরীয়)
- পর্ব-০৪: পৃথিবীর গল্প: চার সভ্যতার লীলাভূমি মেসোপটেমিয়া (আসেরীয়া-ব্যাবিলনিয়া-হিটাইট-ক্যাসাইট-নব্য আসেরীয়া- নব্য ব্যবিলনীয়া)
- পর্ব-০৫: পৃথিবীর গল্প: ফারাও শাসনের উত্থান ও বিকাশ-ফারাও এবং কুশাইট শাসন
- পর্ব-০৬: পৃথিবীর গল্প: ফারাও শাসনের পুনরুত্থান-ফারাও-আকিমানিদ-আক্সুমাইট
- পর্ব-০৭: পৃথিবীর গল্প- আকিমানিদ-মেসিডোনিয়-জরথুস্ত্রবাদ-সিলুসিদ (পারস্য সভ্যতা-১)
- পর্ব-০৮: রোমক সভ্যতার উত্থানঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (১ম ভাগ)
- পর্ব-০৯: রোমক গণপ্রজাতন্ত্রঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (২য় ভাগ)
- পর্ব-১০: রোমক সাম্রাজ্যঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (৩য় ভাগ)
- পর্ব-১১: রোমক সাম্রাজ্যের পতনঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (৪র্থ ভাগ)
- পর্ব-১২: বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন