চার ভাগে ভিভক্ত রোমক সাম্রাজ্য

চার সম্রাটের এক বছর (৬৮-৬৯)

নেরোর মৃত্যুর পরে রোমে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ বছরের মধ্যে একে একে তিন জন সম্রাট হয়ে রোমের সিংহাসনে বসে, কিন্তু কেউ টিকতে পারেনি। প্রথমে এলেন নিয়োগকৃত হিস্পানিয়াতে (বর্তমান স্পেন) রোমের গভর্নর গালবা। টিকলেন মাত্র সাত মাস। গালবাকে হত্যা করে ক্ষমতায় এলেন নেরোর পুরাতন রাজ সহচর- অথো। অথো ছিলো নেরোর স্ত্রী সাবিনার আগের স্বামী, সাবিনাকে বিয়ে করার জন্য যাকে নেরো লুসিতানিয়ায় (বর্তমান পর্তুগাল) পাঠিয়ে দিয়েছিলো। অথো টিকলো মাত্র তিন মাস। অথোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জারমেনিয়ার গভর্নর ভিতেলিয়াসব্যাডরিয়াকামের যুদ্ধে অথোকে পরাজিত করে ক্ষমতায় বসে ভিতেলিয়াস। কিন্তু বিধি বাম। মাত্র আট মাস পরে এই ব্যাডরিয়াকামেই আরেক যুদ্ধে তাকে সাম্রাজচ্যুত করে রোমের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা এক জেনারেল ভেসপাসিয়ান। এই ভেসপাসিয়ান রোম সাম্রাজ্যে নতুন রাজবংশের সূচনা করে।

ফ্লাভিয়ান রাজবংশ

ভেসপাসিয়ানের এ রাজবংশ ফ্লাভিয়ান রাজবংশ (৬৯-৯৬)নামে পরিচিত। ফ্লাভিয়ান রাজবংশ ভেসপাসিয়ান ও তার দুই ছেলেকে (টাইটাসডমিশন) নিয়ে মাত্র ২৭ বছর রোম শাসন করেছিলো। ভেসপাসিয়ানের পরে অল্প সময়ের জন্যে শাসন করলেও টাইটাস জনপ্রিয় শাসক ছিলো; কিন্তু ডমিশন ছিলো এক স্বৈরশাসক। তার রাজত্বকাল ‘ভয়াল শাসন’ (৮৯-৯৬) নামে পরিচিত। এর পরে রোমকদের আবার সুদিন ফিরে আসে।

পাঁচ সুশাসক

রাজ বিদ্রোহে ডমিশনকে হত্যা করা হলে, ফ্লাভিয়ান রাজবংশের রাজ সভার সদস্য নেরভা রোমক সাম্রাজ্যের হাল ধরেন। নেরভা থেকে শুরু করে পর পর পাঁচ শাসকের সময়কালকে রোম সাম্রাজ্যের ‘পাঁচ সুশাসক’ (৯৬-১৮০) বলে ধরা হয়। এরা হলো- নেরভা, ট্রেইজান, হাদ্রিয়ান, এন্তোনিয়াস পাইয়াস ও মার্কাস অরেলিয়াস।  মার্কাস অরেলিয়াসের রাজত্বকাল শেষ হয় ১৮০ সালে। সেই সাথে শেষ হয় অগাস্টাসের সময়ে শুরু হওয়া ‘প্যাক্স রোমানা’ বা রোমক শান্তির সময়কাল। পাঁচ সুশাসকের সাথে শেষ সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের পুত্র কমোডাসের শাসনকালের শেষ সময় (১৯২) পর্যন্ত রোমক রাজবংশ নেরভা-এন্তোনাইন রাজবংশ (৯৬-১৯২) নামে পরিচিত।

নেরভার সোয়া এক বছরের শাসনের পরে রোমক সম্রাট হয় তার পালিত পুত্র ট্রেইজান। পিতা পুত্র দুই জনেই রোম সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক সংস্কার, ইমারত নির্মাত, রাস্তাঘাট পুনসংস্কার ও রাজ্য বিস্তার অব্যাহত রাখে। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য আজও মানুষকে বিমোহিত করে। এটি হলো রোমের বিখ্যাত উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ কলোসিয়াম। প্রায় দশ বছর (৭০-৮০) ধরে এটি নির্মাণ করা হয়। ১৯ বছর শাসন করে ট্রেইজান মারা গেলে তার পালিত পুত্র হাদ্রিয়ান রোমক সম্রাট হয়।

হাদ্রিয়ানের দেয়াল এনতোনাইনের দেয়াল

বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে রোমক আধিপত্য বিস্তারে করলেও কেল্টিক জনগোষ্ঠী পিক্টসদের বিরোধীতার মুখে রোমানরা উত্তরে খুব বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি। পিক্টসদের সাথে রোমানদের ছোটখাটো খুঁনসুঁটি লেগেই থাকতো। স্কটিশ মাটিতে রোমানদের সাথে পিক্টসদের প্রথম বড়সড় যুদ্ধের নাম মনস গ্রাউপিয়াসের যুদ্ধ (Battle of Mons Graupius)। ৮৩-৮৪ সালে এ যুদ্ধে রোমান গর্ভনর এগ্রিকোলা দশ হাজার পিক্টসকে হত্যা করেছিলো বলে অনুমান করা হয়। এর পরে রোমানরা পিক্টসদের সাথে আর কখনো সুবিধা করতে পারেনি। তাই পিক্টসদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য রোমানরা উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে দুটি দেয়াল গড়ে তোলে। এদের একটি নাম হাদ্রিয়ানের দেয়াল (১২২) এবং অপরটি এনতোনাইনের দেয়াল (১৪২)। পাঁচ সুশাসকের চতুর্থ জন এন্তোনাইনের শাসনামলে তৈরি হয় এনতোনাইনের দেয়াল। এ দেয়াল ছিল হাদ্রিয়ানের দেয়ালের আরো উত্তরে। তবে এ দেয়াল বরাবর রোমকরা তাদের সাম্রাজ্যের সীমারেখা ধরে রাখতে পারেনি। পরে শুধু হাদ্রিয়ানের দেয়াল পর্যন্ত রোমানদের আধিপত্য টিকে ছিল। 

বৃটেনে রোমক দেয়াল
বৃটেনে রোমক দেয়াল

প্যানথিয়ান মন্দির

হাদ্রিয়ানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি রোমকদের সকল দেবতার মন্দির প্যানথিয়ন প্রতিষ্ঠা (১১৩-১২৫)। তবে এ মন্দিরের গোড়াপত্তন হয়েছিলো ট্রেইজানের সময়ে। মন্দিরটি এখন ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯ শতকের দুই জন রোমক শাসক ভিক্টর ইমানুয়েল দ্বিতীয়উমবেরতো প্রথম এবং তার স্ত্রী মার্গারিতাকে এখানে সমাহিত করা হয়। 

বার কোখবা বিদ্রোহ

হাদ্রিয়ানের আমলে রোমান প্রদেশ যুযেয়াতে একটি ইহুদি নেতা বার কোখবার নেতৃত্বে রোমকদের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ হয়েছিলো। একে ইহুদি-রোমক দ্বিতীয় যুদ্ধও (১৩২-১৩৬) বলে। তবে অনেক ঐতিহাসি একে তৃতীয় ইহুদি-রোমক যুদ্ধও বলে। এরা কিটোস যুদ্ধকে (১১৫-১১৭) ইহুদি-রোমক দ্বিতীয় যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে। ইহুদি-রোমক প্রথম যুদ্ধ, কিটোস যুদ্ধ ও বার কোখবা বিদ্রোহ- এ তিনটি যুদ্ধকে একত্রে ইহুদি-রোমক যুদ্ধ বলে। তিনটি যুদ্ধেই রোমকরা জয়লাভ করে।

মার্কাস অরেলিয়াস

১৩৮ সালে হাদ্রিয়ানের মৃত্যুর পরে রোমক সম্রাট হয় হাদ্রিয়ানের পালক পুত্র এন্তোনিয়াস পাইয়াস। তার ২৩ বছর শাসনের পরে ১৬১ সালে এন্তোনিয়াস পাইয়াস মারা গেলে তার দুই পালক পুত্র মার্কাস অরেলিয়াস (Emperor) ও লুসিয়াস ভেরুস (Co-Emperor) রোমক সম্রাট হয়।  ১৬৯ সালে ভেরুস মারা যায়। এর পরে ১৭৭ থেকে অরেলিয়াসের পুত্র কমোডাস পিতার সাথে যৌথ ভাবে রাজ্য শাসন করে। ১৮০ সালে মারা যায় অরেলিয়াস। এর পরে ১৯২ সাল পর্যন্ত কমোডাস রোমক রাজ্যের সম্রাট ছিলো।

অরেলিয়াস এক জন বিখ্যাত বৈরাগ্যবাদী (stoic) দার্শনিক ছিলো। তার আত্মসংযম ও সুখে-দুঃখে নিস্পৃহতার আদর্শ আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে। বৈরাগ্য দর্শনকে ভিত্তি করে ‘মেডিটেশনস’ নামে অরেলিয়াস ১২-টি বই লিখেছিলেন।

রোমক-পার্থিয়া যুদ্ধ

রোম সামাজ্যের আগের দুটি বৃহৎ সাম্রাজ্য হলো গ্রিক সাম্রাজ্য ও পারস্য (ইরান) সাম্রাজ্য। গ্রিকদের মহাবীর মহান আলেকজান্ডারের হাতে পারস্য সাম্রাজ্যে পতনের পরে তার সেনাপতি সেলুকাসের হাত ধরে সেখানে সেলুসিদ সাম্রাজ্য (৩১২-৬৩ খ্রিস্টপূর্ব) গড়ে ওঠে। সেলুসিদ সাম্রাজ্য পতন হয় পারস্য সাম্রাজ্যের একটি অংশের হাতে। বর্তমান ইরান-সিরিয়া অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা এ সাম্রাজ্যের নাম পার্থিয়ান সাম্রাজ্য (২৪৭ খ্রিস্টপূর্ব -২২৪ খ্রিস্টাব্দ)। এ থেকে বোঝা যায় পার্থিয়ান সাম্রাজ্য ও রোমক সাম্রাজ্য একটি সমসাময়িক সাম্রাজ্য।

পার্থিয়ানদের সাথে রোমকদের যুদ্ধ-বিদ্রোহ (৫৪ খ্রিস্টপূর্ব- ২১৭ খ্রিস্টাব্দ) লেগেই থাকতো। এদের মধ্যে ৫৩ খ্রিস্টপূর্বে প্রথম বড় যুদ্ধ, কারহের যুদ্ধ হয়েছিলো। এর পরের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হলো রোমক জেনারেল মার্ক এন্থনির যুদ্ধ (৩৬ খ্রিস্টপূর্ব) । তৃতীয়টির নাম ট্রেইজানের পার্থিয়া অভিযান (১১৫-১১৭)। এই তিন যুদ্ধেই পার্থিয়ানরা জয়লাভ করে। পার্থিয়ানদের বিরুদ্ধে সফলতা পেয়েছিলো মার্কাস অরেলিয়াস। অরেলিয়াসের নেতৃত্বে ছয় বছর (১৬১-১৬৬) ধরে চলা রোমক-পার্থিয়া যুদ্ধে রোমকরা জয় পেয়েছিলো। তবে ২১৬-১৭ সালে শেষ রোমক-পার্থিয়া যুদ্ধে (কারাকালার পার্থিয়ান যুদ্ধ) পার্থিয়ানরা আবার জয়লাভ করে। রোমক-পার্থিয়া যুদ্ধ শেষ হলেও পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের পরবর্তী সাম্রাজ্য সাসানিয় সাম্রাজ্যের (২২৪-৬৫১) সাথে আরো চারশো বছরের অধিক সময় রোমকদের যুদ্ধ লেগে ছিল। প্রায় পৌনে সাতশো বছর ধরে চলা এ সব যুদ্ধসমূহ একত্রে রোমক-পারস্য যুদ্ধ (৫৪ খ্রিস্টপূর্ব- ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ)নামে পরিচিত।

মার্কোমনির যুদ্ধ

রোমের পূর্ব দিকে পার্থিয়ানদের মতো উত্তর দিকের জার্মানির যাযাবর ও অন্যান্য জাতিগুলোর সাথেও রোমকদের যুদ্ধ বিবাদ লেগে থাকতো। রোমকদের সাথে জার্মানির (যাযাবর) জাতিগুলোর সাথে প্রায় সাড়ে চারশো বছরের শতাধিক যুদ্ধসমূহ একত্রে রোমক-জার্মানিয় যুদ্ধ (১১৩ খ্রিস্টপূর্ব- ৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ) নামে পরিচিত। অরেলিয়াসের শাসনামলে প্রায় ১৫ বছর (১৬৬-১৮০) ধরে জার্মানিয় জাতি মার্কোমনিকাদিদের সাথে রোমকদের যুদ্ধ হয়েছিল। এটি মার্কোমনির যুদ্ধ নামে খ্যাত। এ যুদ্ধে অরেলিয়াস জয়লাভ করেছিলো।

এন্টোনাইন প্লেগ

অরেলিয়াসের রাজত্বকালে টানা ১৬ বছর (১৬৫-১৮০) ধরে রোমে প্লেগ রোগের মহামারি ঘটেছিল। এ মহামারি এন্টোনাইন প্লেগ নামে পরিচিত। অনেকে মনে করে, এটা গুটিবসন্ত বা হাম জাতীয় রোগ ছিলো। সম্ভবত, চীনে এ রোগের উৎপত্তি হয়। পরে সিল্ক রোডের দিয়ে রোমক সৈন্যদের মাধ্যমে এটি রোমকে আক্রান্ত করেছিলো। অরেলিয়াসের ভাই রোমক সম্রাট লুসিয়াস ভেরুসও এই প্লেগে মারা যায়। দ্বিতীয় দফায় ২৫১ থেকে ২৬৬ সালেও এ রোগ রোমে আঘাত হেনে ছিলো। দুই দফায় আনুমানিক ৬-৭ কোটি মানুষ এন্টোনাইন প্লেগে মারা যায়।

কমোডাস

অরেনিয়াসের মৃত্যুর পরে ১৮০ সালে নেরভা-এন্তোনাইন রাজবংশের শেষ সম্রাট হিসেবে ক্ষমতায় বসে কমোডাস। ক্ষমতায় আরোহনের পর থেকেই সে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে। ১৮২ সালে প্রথম আঘাত আসে বোন লুসিলার কাছ থেকে। এ যাত্রায় কমোডাস বেঁচে যায়। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মধ্যে থেকে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে কমোডাস স্বৈরশাসক হয়ে ওঠে। সে নিজেকে দেবতার পদমর্যাদায় আসীন করে সর্বময় ক্ষমতার আধার হয়ে ওঠে। ফলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও জনরোষ দুই-ই সমধিক হারে বাড়তে থাকে।

রোমক সাম্রাজ্যে মানুষ বা বন্য প্রাণির সাথে যুদ্ধে পারদর্শী এক দল যোদ্ধা ছিলো। এরা গ্লাডিয়েটর নামে পরিচিত ছিল। রোমকরা অর্থ উপার্জনের জন্য স্বেচ্ছায়, রোমক দাসরা মুক্তির আশায় গ্লাডিয়েটরের পেশা বেছে নিতো। সম্রাট কমোডাসের গ্লাডিয়েটর হিসেবে মল্ল যুদ্ধ করা নেশা ছিলো।  ১৯২ সালের নভেম্বর মাসে সে রোমে বিশাল মল্ল যুদ্ধের আয়োজন করে যেখানে সে প্রতিদিন সকালে তীর ও বর্শা শত শত প্রাণি হত্যা করতো। 

এ বছরের শেষ দিনে তাকে প্রথমে খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। তবে সময়মত বমি করে ফেলার কারনে সে বেঁচে যায়। কিন্তু, তার পরেই তার মল্লযুদ্ধের সাথী নার্সিসাস গোসলের সময় তাকে গলা টিপে হত্যা করে। মৃত্যুর পরে রোমক সিনেট তাকে ‘জন শত্রু’ ঘোষণা করে।

রোমক সাম্রাজ্য ১৮০
রোমক সাম্রাজ্য (১৮০ সাল)

রোম সাম্রাজ্যের সঙ্কট

পাঁচ সম্রাটের বছর

কমোডাসের মৃত্যুতে রোমে গৃহ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। সেই এক বছরে (১৯৩) রোমের সিংহাসনে পাঁচ জন সম্রাট বসেছিলো। এরা হলো পার্টিন্যাক্স, ডিডিয়াস জুলিয়ানুস, পেসেনিয়াস নাইজার, ক্লডিয়াস আলবিনুসসেপটিমিয়াস সেভেরুস। অবশেষে যুদ্ধবাজ সেভেরুস রোম সাম্রাজ্যের হাল ধরেন। সে তার দুই পুত্র- কারাকালা (১৯৮-২১১) ও গেতাকে (২০৯-১১) নিয়ে ১৯৩ সাল থেকে ২১১ সাল পর্যন্ত রোম সাম্রাজ্য শাসন করে সেভেরান রাজবংশ (১৯৩-২৩৫)প্রতিষ্ঠা করে।

সেভেরান রাজবংশ

২১১ সালে ফেব্রুয়ারিতে সেভেরুস ও ডিসেম্বরে গেতা মারা যায়। এর পর থেকে কারাকালা সেভেরান রাজবংশের দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকে। তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে ‘কনসটিটিউটিও এন্তোনিনিআনা’ আইন (২১২) প্রণয়ন করে রোমক সাম্রাজ্যভূক্ত প্রায় সকল স্বাধীন লোককে নাগরিকত্ব প্রদান উল্লেখযোগ্য।  একটি ২১৭ সালে শেষ রোমক-পার্থিয়া যুদ্ধের সময় জাস্টিন মার্শিয়ালিস নামে পদোন্নতির আকাঙ্খী এক রোমক সৈন্য কারাকালাকে ছুরি মেরে হত্যা করে। এ সুযোগে কারাকালার সেনাদলের অন্তর্গত মৌরিতানিয়ার বংশোদ্ভূত এক সেনাধ্যক্ষ ম্যাক্রিনাস নিজেকে রোমক সম্রাট ঘোষনা করে। ম্যাক্রিনাস রোমক সিনেটের বাইরে প্রথম রোমক সম্রাট। সে তার পুত্র ও সহযোগী সম্রাট ডিয়াডুমেনিয়ান মিলে মাত্র বছর খানেক নিজের পদ ধরে রাখতে পেরেছিলো। রোমক সিনেট দু’জনকেই হত্যা করে।

কারাকালা কাজিন এলাগাবালুসের রাজ্যাভিষেকের মাধ্যমে ২১৮ সালে সেভেরান রাজবংশ আবার রোমের ক্ষমতায় ফিরে আসে। এলাগাবালুসের মাত্র বছরের শাসনামল ছিল যৌন কেলেংকারি ও ধর্ম অবমাননায় পরিপূর্ণ। সে সিরিয়া অঞ্চলের সূর্য দেবতা এলাগাবালকে রোমক প্যানথিয়নের প্রধান দেবতা হিসেবে, অর্থাৎ রোমক প্রধান দেবতা জুপিটারের উপরে অধিষ্ঠিত করে এবং নিজেকে প্রধান রোমক পাদ্রী হিসেবে ঘোষণা করে। ২২২ সালে এলাগাবালুসকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পরে কারাকালার আরেক কাজিন সেভেরাস আলেক্সজান্ডার সেভেরান রাজবংশের শেষ সম্রাট হিসেবে রোম শাসন করে।

২৩৫ সালে সেভেরাস আলেক্সজান্ডারের হত্যার পর থেকে পরবর্তী ৫০ বছরে (২৩৫-২৮৪) সামরিক নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে রোম সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস তৈরি হয়। এ সময় কালে কমপক্ষে ২৬ জন সামরিক শাসক নিজেদেরকে রোমক সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করে। তবে কেউই বেশি দিন টিকতে পারেনি।

এ সময়কালে আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও গৃহযুদ্ধে রোমক রাজ্যগুলো ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এভাবে রোম তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে- ক) ফ্রান্স, বৃটেন ও স্পেনের কিছু অংশ নিয়ে গ্যালিক; খ) সিরিয়া, ইসরাইল ও মিশর নিয়ে পালমাইরিন; এবং গ) রোম সাম্রাজ্যের বাকী অংশ। রোমের এ ক্রান্তি লগ্নে ২৮৪ সালে যে সম্রাট রোমের হাল ধরেন তার নাম ডাইক্লিশান।

ডাইক্লিশানের টেট্রার্কি

ডাইক্লিশান ছিন্ন-ভিন্ন রোম সাম্রাজ্যকে পুনরায় সংগঠিত করে চার ভাগে বিভক্ত করে চার জন সম্রাটের রাজ্যভূক্ত করেন। এই চার জন হলেন- ডাইক্লিশান (এশিয়া মাইনর অঞ্চল থেকে মিশর পর্যন্ত, রাজধানী নিকোমেডিয়া বা বর্তমানে তুরস্কের ইজমিত), কনসট্যানটিআস (ফ্রান্স থেকে বৃটেন পর্যন্ত, রাজধানী বর্তমান জার্মানির ট্রাইয়ার), ম্যাক্সিমিয়ান (ইতালি, স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা, রাজধানী মিলান) ও গ্যালেরিয়াস (এথেন্স থেকে শুরু করে বলকান অঞ্চল, রাজধানী বর্তমান সার্বিয়া শ্রেমস্কা মিত্রোভিকা)। ৩১৩ সাল পর্যন্ত এ শাসন ব্যবস্থা টিকে ছিলো।

চার ভাগে ভিভক্ত রোমক সাম্রাজ্য
চার ভাগে ভিভক্ত রোমক সাম্রাজ্য

রোমক সাম্রাজ্যের পতন

খ্রিস্টানদের অত্যাচার ও নিপীড়ন

ডাইক্লিশান ও বাকী তিন সম্রাট মিলে ৩০৩ সালে খ্রিস্টানদের অত্যাচার শুরু করে। ইতিহাসে এ নির্যাতন ‘নৃশংস নিপীড়ন’ (৩০৩-৩১২) নামে পরিচিত। এ সময়ে তাদেরকে রোমক বহুঈশ্ববাদের (প্যাগানিজম) ধর্মের আচার নীতি মেনে চলা, রোমক দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলী দেয়া ইত্যাদির বিভিন্ন আইন করা হয়েছিলো। যারা এসব মানতো না তাদেরকে বন্দী বা হত্যা করা হতো। তবে এ অত্যাচার ও নিপীড়নে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব কমেনি, বরং বাড়তে থাকে।

মহান কনস্ট্যান্টাইন

চার ভাগে বিভক্ত রোমের ফ্রান্স থেকে বৃটেন পর্যন্ত অঞ্চলের সম্রাট কনসট্যানটিআসের মৃত্যুর পরে পুত্র কনস্ট্যান্টাইন (১ম) সাম্রাজ্যের হাল ধরে। ৩০৫ সালে ডাইক্লিশান সম্রাটের পদ থেকে সরে গেলে বাকী রাজ্যগুলোতে যখন নৈরাজ্য বাড়তে থাকে তখন কনস্ট্যান্টাইন একে একে সে সব অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সে তুরস্কের বাইজানটিয়ামে (বর্তমান ইন্তানবুল) তার রাজধানী স্থাপন করে শহরটির নাম বাইজানটিয়াম থেকে পরিবর্তন করে কনস্ট্যান্টিনোপল রাখে। ৩৩৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে রোমক সম্রাট ছিলো।

মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধ

বিভিন্ন অঞ্চল দখলের সময়ে চার ভাগে বিভক্ত রোমের ইতালি, স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা অংশের সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ানের পুত্র ম্যাক্সেটিয়াসের সাথে রোমের মিলভিয়ান সেতুর নিকটে কনস্ট্যান্টাইনের একটি যুদ্ধ হয়েছিল। এর নাম মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধ (৩১২)।বলা হয় যে, এ যুদ্ধের আগেকনস্ট্যান্টাইনকে স্বপ্নে সৈন্যদের ঢালে ল্যাটিন ক্রস বা ‘কি-রো’ (Chi-Rho) প্রতিক আঁকতে বলা হয়। স্বপ্ন মোতাবেক কনস্ট্যান্টাইন সৈন্যদের ঢালে ক্রস চিহ্ন আঁকেন। এ যুদ্ধে সে জয়লাভ করেছিলো।

প্রথম রোমক শাসক হিসেবে কনস্ট্যান্টাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। খ্রিস্টধর্মে ইতিহাসে একটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ফলে সে রোরক রাজ্য সমূহে সকল ধর্মের সমান অধিকার প্রদান করে। তার উদ্যোগে আইন বলে ৩১৩ সালে ডাইক্লিশানের আমলে শুরু হওয়া খ্রিস্টানদের অত্যাচার বন্ধ করে। এভাবে প্রায় তিনশো বছর পরে খ্রিস্টধর্ম একটি স্বাধীন ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। কনস্ট্যান্টাইন খ্রিস্ট ধর্মে ঋষির মর্যাদা পেয়ে থাকে। যে ক্রুসে যীশু খ্রিস্টকে ক্রুসবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই আসল ক্রসকে কনস্ট্যান্টাইনের মা সেন্ট হেলেনা (৩২৬) জেরুজালেম হতে কনস্ট্যান্টিনোপলে নিয়ে যায়।

কনস্ট্যান্টাইনের পরে তার পুত্র ২য় কনস্ট্যান্টাইনও দীর্ঘকাল (৩৩৭-৩৬১) রোমের শাসন ক্ষমতায় ছিলো। সে পিতার মতো খ্রিস্ট ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলো; কিন্তু ইহুদি ও বহুঈশ্বরবাদীদের প্রতি ছিলো কঠোর। বিশেষ করে সে বহুঈশ্বরবাদী বা প্যাগানদেরকে অত্যাচার, নির্যাতন শুরু করে। ফলে জার্মান অঞ্চলের যাযাবর প্যাগান জাতিদের (গোথ, ভ্যান্ডাল ইত্যাদি) সাথে রোমকদের শত্রুতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার বিরুদ্ধে সামরিক নেতা ম্যাগনেনতিয়াস নেতৃত্বে একটি গৃহ যুদ্ধ (৩৫০-৩৫৩) হয়েছিল; তবে তা টেকেনি।

খ্রিস্টধর্ম রাষ্ট্রীয় ধর্ম

২য় কনস্ট্যান্টাইন মৃত্যু কালে চাচাত ভাই (মহান কনস্ট্যান্টাইনের সৎ ভাই জুলিয়াস কনস্ট্যান্টিয়াসের পুত্র) দার্শনিক জুলিয়ানকে রোমের শাসনকর্তা করে ছিলো। খ্রিস্টধর্ম বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য এই শাসক ‘মুরতাদ জুলিয়ান’ (Julian the Apostate) নামে খ্যাত। পরবর্তীতে রোমক সম্রাট মহান থিয়োডিয়াস ‘থেসালোনিকা আদেশ’ (Edict of Thessalonica) বলে ৩৮০ সালে খ্রিস্ট ধর্মকে রোম সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম করেছিলো। পাশাপাশি সে রোমক বহুঈশ্বরবাদীদের অত্যাচার করে ও তাদের মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলে।

রোম সাম্রাজ্যের বিভাজন

পশ্চিম ও পূর্ব রোমক সাম্রাজ্য
পশ্চিম ও পূর্ব রোমক সাম্রাজ্য

থিয়োডিয়াস অখণ্ড রোম সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট (৩৭৯-৩৯৫)। ৩৯৫ সালে তার দুই পুত্র- হোনোরিয়াস ও আর্কাডিয়াস রোম সাম্রাজ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। হোনোরিয়াস পশ্চিম রোম সাম্রাজ্য ও আর্কাডিয়াস পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের শাসক হয়েছিল। পূর্ব রোম সাম্রাজ্য পরবর্তীকালে বাইজানটাইন সাম্রাজ্য নামে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত টিকে ছিলো।

রোমক সম্রাটদের হাতে বিভিন্ন সময়ে বার বার পরাজিত হওয়া যাযাবর প্যাগান জাতিদের হাতে রোম সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিলো। এর মধ্যে ছিলো জার্মানিয় অঞ্চলের গোথ, ভিসিগোথ, অস্ট্রাগোথ ও ভ্যান্ডাল; স্ক্যান্ডিনেভিয় অঞ্চলের এংলো, জুটেস ও স্যাক্সন; ফ্রান্স অঞ্চলের ফ্রাঙ্কস ও মধ্য এশিয়ার হুন জাতি।

৪১০ সাথে ভিসিগোথদের প্রথম রাজা এলারিক রোম লুণ্ঠন করে রোমের পতনের সূচনা করে। এর পরে রোমের পতন ছিলে কেবল সময়ের ব্যাপার। হোনোরিয়াসের শাসনকালের (৩৯৫-৪২৩) পরে ৩য় ভ্যালেনতিনিয়ান ৪৫৫ সাল পর্যন্ত পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের শাসক পদে ছিলো। তার সময়কালে হুন জাতি উভয় রোম সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল। ৪৫২ সালে ‘আতিলা দ্য হুন’ নামক বিখ্যাত হুন শাসক রোম আক্রমণ করেছিল। পরের বছর আতিলা মারা যায়।

রোমক সাম্রাজ্যে আক্রমণ
রোমক সাম্রাজ্যে আক্রমণ

৩য় ভ্যালেনতিনিয়ানের পরে আরো বেশ কয়েক জন সম্রাট পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের হাল ধরার চেষ্টা করলেও তাদের কেউই বেশি দিন টিকতে পারেনি। পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকেন যাযাবর নেতা ওডোয়েসার। সে শেষ রোম শাসককে পরাজিত করে রোমক সম্রাট (৪৭৬-৪৯৩) হয়েছিলো।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এ সাম্রাজ্যের শেস শাসকের নাম ছিল রোমুলাস। রোমের জন্ম ইতিহাসের সাথে জড়িত দুই ভাইয়ের একজনের নামও ছিলো রোমুলাস। এক রোমুলাসের হাতে জন্ম নেয়া এক সভ্যতার আরেক রোমুলাসের হাতে ৪৭৬ সালে পতন হয়।

(ধারাবাহিকভাবে পৃথিবীর গল্প চলবে)

পৃথিবীর গল্প পরম্পরা