ডেলফির ওরাকল- সত্য না কি পৌরাণিক গল্প

ডেলফির ওরাকল (Oracle of Delphi) এক রহস্যের মায়াজাল

গ্রিক পুরাণ-এ ডেলফির ওরাকল একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সে কালের ভবিষ্যৎবাণীর আধার এই ডেলফির ওরাকল কি সত্য ছিল? না কি এসব কেবলই পৌরাণিক গল্প?

গ্রিসের করিন্থ উপসাগরের উত্তরে পারনাসাস (Parnassus) পর্বতের দক্ষিণ ঢালে ডেলফি মন্দির অবস্থিত। খ্রি.পূর্ব অষ্টম শতকে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মন্দিরকে গ্রিক দেবতা এ্যাপোলোর মন্দিরও বলে। এ জন্য এ্যাপোলো সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে।

হিন্দু পুরাণে যেমন ঋষি কশ্যপ ঔরসে অদিতির গর্ভে দ্বাদশ আদিত্য বা সূর্য দেবতা জন্ম নিয়েছিল, তেমনি গ্রিক পুরাণেও মহাকাশ পিতা ইউরেনাস ও ধরিত্রি মাতা গায়ার দ্বাদশ টাইটান সন্তান ছিল। এদের ছয় জন ছিল টাইটান (পুরুষ) আর বাকী ছয় জন ছিল টাইটানেস (মহিলা)। একত্রে সবাইকে টাইটান বলে। পুরুষ-মহিলা হিসেবে জোড়ায় জোড়ায় এই টাইটানরা হলো-অকেয়ানোসতেথুস, হাইপেরিয়নথেইয়া, কয়উস ও ফয়বে, ক্রোনাসরেয়া, নেমোসাইনেথেমিস, ক্রিউস ও ইয়াপেতুস

ঐ বারো জনের পরে আরো বারো জন গ্রিক দেবতার আবির্ভার ঘটে। গ্রিক পুরাণে টাইটানদের থেকে এদের প্রভাব অনেক বেশি। এদেরকে বলে দ্বাদশ অলিম্পিয়ান দেবতাএরা হলো জিউস, হেরা, পোসেইডন, দেমেতের, এথেনা, এ্যাপোলো, আর্তেমিস, আরেস, আফ্রোদিতি, হেফাইসতস, হার্মিস এবং ডায়োনিসাস

টাইটান কয়উস ও ফয়বের কন্যার নাম ছিল লেটো। এই লেটোর গর্ভে উপরের বারো অলিম্পিয়ান দেবতাদের শ্রেষ্ঠ দেবতা জিউসের ঔরসে যমজ সন্তানের জন্ম হয়। এদের নাম এপোলো ও আর্তেমিস। এরা দু’জনও বারো অলিম্পিয়ানের অন্তর্গত।

এ্যাপোলো মূলত সূর্য দেবতা। তার অনেকগুলো ক্ষমতার একটি হলো ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা। ডেলফি মন্দির থেকে এ ভবিষ্যৎ বাণী করা হতো। এ জন্য এ বাণীগুলোকে বলা হতো ডেলফির ওরাকল। তবে এ্যাপোলো নিজে কখনো ভবিষ্যৎবাণী করতো না। তার পক্ষে এ মন্দিরের নারী পুরোহিতরা এ সব বাণী করতো। এ অনেকটা আমাদের দেশের জ্বীন হাজির করার মতো। যে সব নারীরা এ কাজ করতো তারা পাইথিয়া (Pythia) নামে পরিচিত। এক জন পাইথিয়া মারা গেলে মন্দিরের অন্য নারী হতে এক জনকে পাইথিয়া নির্বাচিত করা হতো। পাইথিয়ারা সব সময় উচু বংশের শিক্ষিতা নারী ছিল। পারনাসাস নামের এক পাথরের উপর বসে বছরে মাত্র একবার এ ভবিষ্যৎবাণী করা হতো।

ডেলফির ওরাকল চরম রহস্যময় ছিল। শুধু মানুষ নয়, দেবতারা পর্যন্ত এ ওরাকলে সঠিক অর্থ বুঝতে পারতো না। ফলে ডেলফির ওরাকলের গ্যাঁড়াকলে অনেকের সর্বনাশ হয়েছে। যেমন, ওরাকল বুঝতে না পেরে লাইডিয়ার রাজা ক্রোয়েসাস (রাজ্যকাল ৫৬০-৫৪৭ খ্রিঃপূঃ) পারস্য রাজ মহান সাইরাসের (Cyrus the Great) বিরুদ্ধে যুদ্ধে করে নিজের রাজ্য হারিয়েছিল। 

লাইডিয়ার রাজা ক্রোয়েসাস মিডিয়া রাজ্য (পরে পারস্য রাজ্য, বর্তমান ইরান) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার আগে ভবিষ্যৎ জানার জন্য ডেলফিতে গিয়েছিল। পাইথিয়াকে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘পারস্য আক্রমণ করলে কি হবে?’ পাইথিয়ার উত্তর, ‘ক্রোয়েসাস যুদ্ধে গেলে একটি বিশাল একটি সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে।’ ক্রোয়েসাস আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তাঁর রাজ্য কতদিন টিকে থাকবে?’ উত্তর এলো, ‘যতদিন পর্যন্ত মিডিয়া সম্রাজ্যের ক্ষমতায় একজন খচ্চর (ঘোড়া ও গাধার শঙ্কর প্রাণি) না আসবে ততদিন লাইডিয়া টিকে থাকবে।’

এটা শুনে আনন্দে ক্রোয়েসাস মিডিয়া রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। খ্রি.পূ. ৫৪৯ সালে মিডিয়া রাজ্যের ক্ষমতায় আসে এক অবিসংবাদিত যোদ্ধা-মহান সাইরাস। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে মাস না পেরুতেই সাইরাস লাইডিয়া দখল করে নেয়। বন্দী হয় ক্রোয়েসাস।

তবে কি ডেলফাইয়ের ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যা ছিল? না, মিথ্যা ছিল না। পাইথিয়া বলেছিল, একটি বিশাল একটি সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে। হ্যাঁ, বিশাল রাজ্য লাইডিয়া ধ্বংস হয়েছিল।

কিন্তু দ্বিতীয় ভবিষ্যৎ বাণী? মিডিয়া সাম্রাজ্যের শাসনে খচ্চর কিভাবে এলো? হ্যাঁ, এটাও সত্য ছিল। পারস্য ও মিডিয়া দুই রাজ্যের দুই বংশের দুইজন ছিল সাইরাসের পিতা-মাতা। যেমনি গাধা ও ঘোড়ার প্রজননে জন্ম নেয় খচ্চর, তেমনি দুই বংশের শঙ্করজাত সন্তান ছিল সাইরাস। শঙ্কর জন্মের বিবেচনায় সাইরাসকে তো খচ্চর বলা যেতেই পারে।

আরেকটি ঘটনা বলি। এটি রোমান সম্রাট নিরোকে নিয়ে। রোমের কুখ্যাত শাসকদের একজন এই নিরো। এ হলো সেই নিরো, যাকে নিয়ে একটি প্রবাদ আছে- রোম পুড়ে যাওয়ার সময় নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিল। তবে সে আসলে বাঁশি বাজাচ্ছিল কি না সে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় না।

তবে এটা সত্য যে, ১৯ জুলাই ৬৪ সালে রোমের ডোমার অরেয়া স্বর্ণ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। নিরো এ ঘটনার জন্য খ্রিস্টানদেরকে দায়ী করেছিলো। কিন্তু অনেক রোমান অধিবাসী মনে করতো যে, নিরো স্বয়ং ডোমাস অরেয়া স্বর্ণ ভবনে আগুন লাগানোর আদেশ দিয়েছিলেন।

মাত্র ষোল বছর বয়সে ৫৪ সালে সম্রাট নিরো (শাসনকাল ৫৪-৬৮) রোমের শাসন ক্ষমতায় আসে। ৫৯ সালে নিরো তার মা এগ্রিপ্পিনাকে হত্যা করে। ৬৭ সালে নিরো ডেলফির ওরাকলের শরণাপন্ন হয়। তখন তার বয়স ৩০। ওরাকল তাকে বলেছিল, ‘ফিরে যাও মাতৃঘাতক! ৭৩ হলো তোমার পতনের ক্ষণ’ (The number 73 marks the hour of your downfall!)।

নিরো মনে মনে খুশি হয়েছিল। সে ভেবেছিল, ৭৩ বছর বয়সে বা ৭৩ সালে তার মৃত্যু হবে’ অর্থাৎ তার হাতে এখনও ৪৩ বা ৬ বছর বাকী আছে। 

কিন্ত বিধি বাম! পরের বছররেই নিরোর মৃত্যু হয়। ৬৮ সালে নিরোর অত্যধিক কর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গল (ফ্রান্স) ও হিস্পানিয়ায় (স্পেন) বিদ্রোহ হয়।  এ বিদ্রোহের অন্যতম নেতার নাম গালবা। এই গালবার আক্রমণের শিকার হয়ে নিরো পালিয়ে যায়। পরে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝোলার ভয়ে ৯ জুন, ৬৮ তারিখে প্রথম রোমান সম্রাট হিসেবে নিরো আত্মহত্যা করে। তার এ আত্মহননের মধ্য দিয়ে রোমে জুলিও-ক্লদিয়ান রাজত্বকালের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রোমে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যা ‘চার সম্রাটের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

মজার ব্যাপার হলো, নিরোকে নিয়ে ওরাকলের ভবিষ্যৎবাণীও বহস্যজনকভাবে সত্য। গালবা যখন নিরোকে ক্ষমতাচ্যুত করে তখন গালবার বয়স ছিল ৭৩। ডেলফির ওরাকল এ ধরনের অনেক ঘটনা আছে।

ডেলফি থেকে শেষ ভবিষ্যৎবাণী করা হয় ৩৯৩ সালে। এ সালে খ্রিস্ট ধর্মালম্বী রোমান সম্রাট থেয়োদোসিয়াস  (Theodosius) পৌত্তলিকতা চর্চার অভিযোগে এই মন্দিরটি বন্ধ করে দেয়। কাকতালীয় হলেও এটা সত্য যে, এ ঘটনার ২ বছর পরে থেয়োদোসিয়াস মারা যায়। তার মৃত্যুর ১৫ বছর পরে (৪১০ সালে) আলারিকের নেতৃত্বে ভিসিগোথ নামের দুর্ধর্ষ এক যাযাবর জাতির হাতে রোমের (পাশ্চাত্য অংশের) পতন ঘটে।  

পুরাণ গাঁথা