গ্রিক পুরাণের সহজপাঠ- অলিম্পিয়ান দেব-দেবীগণ (শেষ ভাগ)

গ্রিক দেব-দেবীদের জন্ম ও বংশপরিচয়ঃ অলিম্পিয়ান দেব-দেবীগণ

গ্রিক পুরাণের সহজপাঠে পূর্বে আরো দুটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথমটিতে গ্রিক পুরাণের আদিম দেব-দেবীগণ এবং দ্বিতীয়টিতে তিতান দেব-দেবীগণের পরিচয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আজকের এই শেষ পর্বে গ্রিক পুরাণের তৃতীয় প্রজন্ম তথা অলিম্পিয়ান দেব-দেবীদের পরিচয় তুলে ধরা হলো।

গ) গ্রিক অলিম্পিয়ান দেব-দেবীগণ

গ্রিক পুরাণের দেব-দেবীদের দ্বিতীয় ভাগে বলা হয়েছে, ক্রোনাস ও রেয়া পরিবারের ছয় সন্তান। এরা হলো তিন পুরুষ- হেডিস, পোসাইডন ও জিউস; এবং তিন মহিলা দেমেতের, হেরা ও হেস্টিয়া। মূলত এদের মাধ্যমেই অলিম্পিয়ান দেব-দেবীগণের কুণ্ডলী গড়ে উঠেছে।

১) হেডিস ও পার্সিফোনি

গ্রিক পুরাণে তারতারাস হলো নরক, আর হেডিস হলো পাতালপুরী (সম্ভবত, নরকের উপরিভাগ)। এই পাতালপুরীর প্রধান দেবতার নাম হেডিস। তার স্ত্রী ছিলো ভাই/বোনের মেয়ে (জিউস ও দেমেতের কন্যা) পার্সিফোনি

২) পোসাইডন- থেসেউস, পেগাসাস

পোসাইডন (রোমান নাম নেপচুন) সমুদ্র, ঝড় ও ভূমিকম্পের দেবতা। সমুদ্র দেবতা হিসেবে পোসাইডন তৃতীয়। প্রথম প্রজন্মে পন্তাস, দ্বিতীয় প্রজন্মে অশিয়ানোস সমুদ্র দেবতা ছিলো। আইথ্রার (Aethra) গর্ভে এথেন্সের প্রতিষ্ঠাতা রাজা আইগেউস (Aegeus) বা পোসাইডনের ঔরসে জন্ম নেয় মহান এক বীর থেসেউস

থেসেউসের প্রথম স্ত্রীর নাম হিপ্পোলিতা। সে ছিল এশিয়া মাইনর বা আনাতোলিয়া (বর্তমান তুরস্ক অঞ্চল) অঞ্চলে বসবাসরত আমাজন জাতির রাণী। তাদের সন্তানের নাম হিপ্পোলাইতাস।  পরে থেসেউস ক্রেতের (Crete) রাজা মিনস (জিউস ও ইউরোপার জ্যেষ্ঠ পুত্র, Minos) ও জলপরী (ওশেনিদ) পাসিফাইয়ের কন্যা ফাইদ্রাকে (Phaedra) বিয়ে করে। ফাইদ্রা ও থেসেউসের আকামাস (Acamas) ও দেমোফোন (Demophon) নামে দুইটি পুত্র ছিল। আফ্রোদাইতির অভিশাপে হিপ্পোলাইতাস সৎ মা ফাইদ্রার  প্রেমে পড়ে ছিলো। পাইরিথস (Pirithous) নামে থেসেউসের এক বন্ধুও ছিল।

থেসেউসের ছয়টি বীরত্বের ঘটনা ‘থেসেউসের ছয় শ্রম’ নামে খ্যাত। সে ‘ক্রোমাইওনিয়ান সাউ’ নামের বিশাল শূকর, ‘ম্যারাথনিয়ান বুল’ নামের বৃহৎ এক ষাড় ও মিনোতারকে হত্যা করে। মিনোতারের দেহের নিম্নাঙ্গ মানুষের ও উপরের অংশ ষাড়ের মতো ছিল। এটা থাকতো ল্যাবারিন্থ নামক একটি স্থানে। এ স্থানটি ছিল গোলকধাঁধাঁর মতো। এতে মানুষ একবার প্রবেশ করলে মানুষ দিক ভ্রান্ত হয়ে যেত। এ জন্য ইংরেজিতে গোলকধাঁধাঁময় স্থানকে ল্যাবারিন্থ (labyrinth) বলে।

থিসিউস যখন মিনোটারকে হত্যার উদ্দেশ্যে গোলকধাঁধাঁয় গমনের জন্য মনস্থির করে, তখন সে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নিয়ে ভাবতে থাকে। সে সময় থেসেউসকে শ্যালিকা আরিয়াদনি একটি সুতার গুটি ধরিয়ে দেয়। গুটির এক মাথা বাইরে রেখে গুটিটি নিয়ে থিসিউস গোলকধাঁধাঁয় প্রবেশ করে। তারপরে সে সুতা ছাড়তে ছাড়তে ভিতরে ঢুকে যায়। মিনোটারকে হত্যা করে পুনরায় সে ঐ সুতা ধরে বেরিয়ে এসেছিল। সুতার ঐ গুটিকে গ্রিক ভাষায় বলতো ক্লু (clew)। তারপরে কালক্রমে clew হয়ে গেল clue।

পোসাইডনের সন্তানদের মধ্যে মেডুসার (মেডুসা সম্পর্কে জানতে ১ম পর্ব পড়ুন) গর্ভে জন্ম নেয়া পেগাসাসক্রাইসেওর উল্লেখযোগ্য। গ্রিক বীর পার্সিউস যখন মেডুসার মাথা কেটে নেয়, তখন এদের জন্ম হয়েছিল। পোসাইডনের অন্যান্য সন্তানগণের পরিচয় জানতে এখানে ক্লিক করুন।

৩) হেস্তিয়া

গ্রিক পুরাণে পারিবারিক ও গৃহস্থালীর সুখশান্তি দেবী হেস্তিয়া। রোমান পুরাণে হেস্তিয়ার সমতূল্য দেবীর নাম ভেস্তা। সে চিরকুমারী ছিলো।

জিউস-পোসাইডন পরিবারের একাংশ

৪) জিউসনামা

৪.১) জিউস ও হেরা পরিবার- আরেস, হেবে ও হেফাস্টাস

অলিম্পিয়ান দেবতাদের প্রধান আকাশ, বজ্র ও বিদ্যুতের দেবতা জিউস (রোমক জুপিটার)। তাকে দেবরাজও বলা হয়। দেবতাদের রাণী, বিয়ে, নারী ও জন্মের দেবী হেরাকে জিউসের একমাত্র বৈধ স্ত্রী বলা যায়। জিউসের ঔরসে হেরার গর্ভে যুদ্ধ দেবতা আরেস (রোমান মার্স), যুদ্ধ দেবী ইনাইও, তারুণ্যের দেবী হেবে, শিশুজন্ম ও ধাত্রী দেবী ইলিথাইয়া ও দেবকারিগর হেফাস্টাস জন্ম নেয়।

৪.২) অ্যাথিনা

গ্রিক ধর্ম ও পুরাণে জ্ঞান, সাহস, অণুপ্রেরণা, সভ্যতা, আইন ও ন্যায়বিচার, যুদ্ধকৌশল, গণিত, শক্তি, কৌশল, চারু ও কারুশিল্প এবং দক্ষতার দেবী অ্যাথিনা জিউসের কন্যা।অশিয়ানোস ও তেথুস কন্যা মেটিস গর্ভবতী হলে জিউস গর্ভবতী মেটিসকে গিলে ফেলে। এর কিছুদিন পর জিউস মাথায় অত্যন্ত যন্ত্রণা বোধ করতে থাকেন। দেব-কারিগর হেফাস্টাস তখন কুড়োল দিয়ে জিউসের মাথা ফাঁক করে দেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পূর্ণ যুবতী অ্যাথিনা রণরঙ্গিনী বেশে চতুর্দিক প্রকম্পিত করে আবির্ভূত হন।

৪.৩) দিয়োনুসোস

ক্রোনাস ও রেয়ার কন্যা ও জিউসের আরেক বোন পৃথিবীর দেবী, বন, ফসলাদি ও কৃষি দেবী দেমেতের। দেমেতের গর্ভে জন্ম নেয় হেডিসের স্ত্রী পার্সিফোনি। এছাড়া সুরা/মদের দেবতা দিয়োনুসোসকে (বা ব্যক্কাস) তাদের পুত্র মনে করা হয়। অন্য মতে, জিউসের ঔরসে সেমেলির গর্ভে জন্ম হয় দিয়োনুসোসের। মা যেই হোক, মূল কথা হলো তার পিতা জিউস।

৪.৪) অ্যাপোলো ও আর্তেমিস

তিতান কয়উস ও ফয়বের কন্যা লেটোর গর্ভে জিউস প্রভাবশালী এক দেবতা ও এক দেবীর জন্ম হয়। অলিম্পিয়ান দেব-দেবীদের মধ্যে এরা দুই জনই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এরা হলো সঙ্গীত, কাব্য, মহামারী, ভবিষ্যতবাণী, ঔষধ, আলো ও জ্ঞানের দেবতা অ্যাপোলো; এবং শিকার, জঙ্গল ও পাহাড় এবং চাঁদের অধিষ্টাত্রী দেবী আর্তেমিস (রোমান ডায়ানা)। অ্যাপোলো ও আর্তেমিস জমজ ছিলো। অ্যাপোলোর ভবিষ্যতবাণীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ওরাকল অভ ডেলফি

জিউসের মতো অ্যাপোলোরও অগণিত সন্তান রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চিকিৎসাবিদ্যার দেবতা আস্ক্লেপিউস (সে মৃত লোকদের আবার জীবিত করে তুলতো বলে জিউস তাকে হত্যা করে),ডেলফি (ডেলফির ওরাকল সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন) শহরের প্রতিষ্ঠাতা ডেলফাস, সমুদ্র দৈত্য সিলা (ডাকিনীবিদ্যার দেবী হাকাতির গর্ভে। তবে তার জন্ম নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। তাকে ফোর্কিস ও সিটোর সন্তানও মনে করা হয়। বিস্তারিত ১ম পর্বে দেখুন) ও কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, কবি, ধর্মগুরু অরফিয়াস।  

সাপের দংশনে অরফিয়াসের স্ত্রী ইউরিডিসের মৃত্যু হয়। স্ত্রীকে ফিরে পাবার জন্য সে হেডিসে চলে যায়। গান শুনিয়ে সে হেডিস এবং পার্সেফোনির হৃদয়কে নরম করে ফেলে। তারা ইউরিডিসকে এক শর্তে পৃথিবীতে ফিরে আসতে দিতে রাজি হয়। সেটা হলো দু’জনেই পৃথিবীতে না পৌঁছানো পর্যন্ত পিছনে ফিরে তাকাতে পারবে না। ইউরিডিসকে অনুসরণ করে সে যাত্রা করলো। কিন্তু পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগে ইউরিডিস  পিছনে তাকালো।  ফলে আবার হারিয়ে গেল, চিরতরে।

৪.৫) হার্মিস

দেবতাদের বার্তাবাহক এবং বাণিজ্য, চৌর্যবৃত্তি, পর্যটন, ক্রীড়া ও সীমান্ত পারাপারের দেবতা হার্মিস (রোমান মারকিউরি) ছিলো জিউস ও মাইয়ার (এটলাস ও ওশেনিদ প্লেইওনির কন্যা) পুত্র। হার্মিস ও দেবী আফ্রোদাইতির পুত্রের নাম হারমাফ্রোডাইট। সে ছিল ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় একজন দেবতা। হারমাফ্রোডাইটকে অসম্ভব ভালোবাসতো সালমাসিস (Salmacis) নামের এক পরী (নাইয়াদ)। সে চিরকাল হারমাফ্রোডাইটের সাথে একত্রে থাকার জন্য সে দেবতাদের কাছে ধন্না দিতে শুরু করে। অবশেষে দেবতারা সালমাসিস ও হারমাফ্রোডাইটকে একত্র করে দেয়। এ জন্য হিজড়া শব্দটির ইংরেজি হারমাফ্রোডাইট (hermaphrodite)।

৪.৬) পার্সিউস

আর্গসের রাজা আক্রিসিউসের কন্যার নাম ছিল দানাইতার সাথে জিউসের মিলনে পার্সিউস নামে এক মহাবীরের জন্ম হয়। দেবতা ও মানুষের মিলনে পার্সিউসের জন্ম হয়েছিল বলে তাকে উপ-দেবতা বলে। পার্সিউসের সবচে বড় বীরত্বের উদাহরণ সে মেডুসাকে হত্যা করে। তারপর মেদুসার মাথা দিয়ে সামুদ্রিক রাক্ষস ক্রেকেনকে পাথর বানিয়ে বধ করে আন্দ্রোমেদাকে (কুশ রাজ্যের রাজকন্যা) ক্রেকেন এর হাত থেকে রক্ষা করে। পরবর্তীতে আন্দ্রোমেদার সাথে তার বিয়ে হয়।

৪.৭) হেরাক্লিস

দেবরাজ জিউস ও আক্লমিনার পুত্র মানবজাতির রক্ষাকর্তা মহাবীর হেরাক্লিস। রোমকরা হেরাক্লিসকে বলতো হারকিউলিস। সে ছিল পার্সিউসের নাতি এবং উপ-দেবতা। থেসেউসের মতো হেরাক্লিসেরও শ্রম রয়েছে। তবে তার শ্রম সংখ্যা ১২-টি যা ‘হেরাক্লিসের দ্বাদশ শ্রম’ নামে পরিচিত।

হেরাক্লিস নিমিয়ার সিংহ, নয় মাথাওয়ালা লার্নিয়ান হাইড্রা ও সর্বভূক স্টিমফেইলিয়ান বার্ডস হত্যা করে;  সোনার হরিণ বা সেরাইনিয়ান হাইন্ড, বন্যশূকর ইরাইম্যানথিয়ান বোয়ার, ভয়ানক ষাড় মিনোতারের পিতা ও তিন মাথাওয়ালা কুকুর সেরবেউসকে আটক করে; এবং মানুষে খেকো দায়োমেদেসের ঘোড়া  ও হেসপেরিদিসের সোনার আপেল চুরি করেছিল।   

৪.৮) হেলেন

ট্রয় যুদ্ধের নাম করলে যে নারীর নাম মনে আসে সে হেলেন। এই হেলেন জিউস ও লেডার কন্যা। লেডা ছিলো স্পার্টার রাণী। জিউস রাজহাঁসের ছদ্মবেশে লেডার সাথে মিলিত হলে হেলেনের জন্ম হয়। লেডার মনুষ্যজাত আরেক কন্যার নাম ক্লাইতেমনেস্ট্রা। সে আগামেমননের স্ত্রী।

৪.৯) তিন মহিমা বা চ্যারিটিজ

জিউস ও জলপরী (ওশেনিদ) ইউরিনমির তিন কন্যা আগলিয়া (বা জ্যোতির্ময়), ইউফ্রোজিনি (বা আনন্দ) ও থালিয়া (বা উৎসব) একত্রে তিন মহিমা বা চ্যারিটিজ নামে পরিচিত। এই তিন জনকে নিয়ে অসংখ্য শিল্পকর্ম রয়েছে।

৪.১০) মিনস

জিউস ও ইউরোপার জ্যেষ্ঠ পুত্র ক্রিটের প্রথম রাজা মিনসইউরোপা ছিলো ফনেশীয় রাজকন্যা। জিউস ষাড়ের রূপ নিয়ে ইউরোপাকে অপহরণ করে। তার নামে ইউরোপ মহাদেশের নামকরন করা হয়েছে। রাজা মিনসের নামে মিনোয়ান সভ্যতার নামকরণ করা হয়েছে। মিনসের আরেক ভাইয়ের নাম রাদাম্যানথাস

দ্বাদশ অলিম্পিয়ান

দ্বাদশ তিতানরা যেভাবে তিতান দেব-দেবীদের মধ্যে অন্যতম ছিল, তেমনি ভাবে অলিম্পিয়ান দেব-দেবীদের যুগেও দ্বাদশ অলিম্পিয়ান ছিলো। এ যুগে পূর্বের অনেকে দেব-দেবীদের দায়িত্বেরও পরিবর্তন ঘটেছে। তবে, কোন কোন দেব-দেবী এই দ্বাদশ অলিম্পিয়ানভুক্ত ছিলো তা বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। অধিকাংশ বিজ্ঞজনের মতে, জিউস ও হেরা; জিউসের ২ ভাই-বোন (পোসাইডন, দেমেতের) এবং ৭ সন্তান (অ্যাথিনা, অ্যাপোলো, আর্তেমিস, আরেস, হেফাস্টাস, হার্মিস, দিয়োনুসোস) ও আফ্রোদাইতিকে একত্রে দ্বাদশ অলিম্পিয়ান বলে। কেউ কেউ দিয়োনুসোসের স্থলে জিউসের আরেক বোন হেস্টিয়াকে দ্বাদশ অলিম্পিয়ানভুক্ত মনে করে।

পুরাণ গাঁথা