চীনা রূপকথা ও লোককাহিনী- তিন কিংবদন্তী ও পাঁচ সম্রাট
রূপকথা ও লোককাহিনী -তিন কিংবদন্তী ও পাঁচ সম্রাট
রূপকথা ও লোককাহিনী – চীনাদের প্রথম ঊনিশশত বছরের ইতিহাস রূপকথা ও লোককাহিনী ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। প্রাচীনতম এ ইতিহাসের সাথে রূপকথা ও লোককাহিনী এতটাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে তাদের ইতিহাস থেকে এ সব রূপকথা ও লোককাহিনী বাদ দিলে ইতিহাস অর্থহীন আর রূপকথা ও লোককাহিনী থেকে ইতিহাস তুলে পৌরাণিক কল্পকথাগুলো আবেদনহীন হয়ে পড়ে।
ফলে ইতিহাসবিদেরা চীনাদের রূপকথা ও লোককাহিনী থেকে নিখাঁদ ইতিহাসকে কখনও আলাদা করে দেখাতে পারেনি। রূপকথা ও লোককাহিনী নির্ভর এ ইতিহাসকে তারা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে লালন করছে।
রূপকথার তিন কিংবদন্তী আর লোককাহিনীর পাঁচ দেবসম্রাটকে নিয়ে রচিত চৈনিক ইতিহাসের সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তবুও তারা চীনা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম অংশীদার হিসেবে আজও সমধিক সমাদৃত। তিন কিংবদন্তী হলো ফুসি (Fu Xi), নোওয়া (Nü Wa) ও ইয়াংদি (Yan Di)।
পাঁচ সম্রাটের মধ্যে রয়েছে হোয়াংদি (Huang Di) , ঝোয়াংসু (Zhuan Xu), দিকু (Di Ku), ইয়াও (Yao), এবং শুং (Shun)। কল্পকাহিনীর এসব কিংবদন্তীদের সাথে চীনা জাতির উদ্ভব, জাতিগোষ্ঠীর উন্মেষ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ নিবিড়ভাবে মিশে আছে।
প্রাচীন সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশে নদীর অবদান অনস্বীকার্য। নদীবিধৌত সমভূমিতে কৃষিকাজ, পশুপালন সুবিধার জন্য যাযাবর আদিম মানুষেরা যখন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তখন তারা নদীতীরে জনবসতি গড়ে তোলে। এ কারণে দজলা-ফোরাতের (টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস) মাঝে মেসোপটেমিয়া, নীল নদের অববাহিকায় মিশরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদের তীরে হরপ্পা-মহোঞ্জাদারো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
চৈনিক সভ্যতার উন্মেষ ও বিস্তারের সাথে হোয়াংহো (Huang Ho) বা ‘হলদে নদী’ ও ইয়াংসি (Yangtze) নদী ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কারণ পাঁচ হাজার বছর আগে এ দুই নদীর মধ্যবর্তী উপত্যকায় চৈনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটে। হোয়াংহো নদী চৈনিক সভ্যতাকে যেমন সমৃদ্ধি দিয়েছে তেমনিভাবে এ নদীর কয়েক দফা ভয়াবহ বন্যা তাদের মূল্যবান অনেক অর্জন কেড়ে নিয়েছে। এ নদীকে তাই ‘চীনের দুঃখ’ নামে অভিহিত করা হয়।
তিন কিংবদন্তী- ফুসি, নোওয়া ও ইয়াংদি
তিন কিংবদন্তীর দুই জন- ফুসি ও নোওয়া ভাই বোন। ফুসির বোন নোয়ার হাতে চীনাদের সৃষ্টি। ওদের বাবা ইন্দ্রদেবতাকে বন্দী করে এক পর্বতের গুহায় আটকের রেখেছিল। পানির তেষ্টায় ইন্দ্রদেব ভয়াবহ আর্তচিৎকার শুরু করে। ইন্দ্রদেবের এ আর্তনাদে ফুসি ও তাঁর বোন নুওয়া সেখানে ছুটে যায়। পান করানোর মতো কোনো পানি না পেয়ে দু’জনেই কাঁদতে শুরু করলে ইন্দ্রদেব তাঁদের অশ্রুজল কোশভরে পান করে। অশ্রজল পানের শক্তিতে সে বন্দীশালা ভেঙে বেরিয়ে আসে। প্রতিদানে নিজের একটি দাঁত তাদেরকে দিয়ে সে বলেছিল, ‘তিনদিনের মধ্যে যখন মানব জাতির উপর ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে তখন যেন তারা এই দাঁতের সাহায্যে নিজেদেরকে রক্ষা করে’। মহাপ্লাবনে হলদে ও ইয়াংসির উপত্যকা ভেসে যেতে লাগলো। দাঁতটি একটি কিস্তিতে রূপান্তরিত হলে দুই ভাইবোন তার উপর চড়ে বসলো। সবাই মরে গেলো, ধ্বংস হলো সবকিছু, বেঁচে থাকলো ফুসি ও নোওয়া। এ কাহিনী একটি বিশেষত্ব হলো মহাপ্লাবন, নোওয়া ও তাঁর কিস্তি যার সাথে নূহের (Noah) প্লাবনের একটি সাদৃশ্যরয়েছে।
মহাপ্লাবনের পানি নেমে গেলে নোওয়া মানুষ সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করলো। হলদে নদীর মাটি দিয়ে পুতুল বানিয়ে তা জীবন্ত করে তুলতে লাগলো। আজকের চীনারা সেই সব মাটির পুতুলের উত্তরসূরী।
তৃতীয় কিংবদন্তী ‘লাল সম্রাট’ ইয়াংদি। তিনি কৃষিকাজের লাঙল ও ভেষজশাস্ত্র আবিস্কার করেন। চীনাদেরকে তিনি ষাড়ের সাথে লাঙল জুড়ে জমি চাষ করে গম, ধান, ভুট্টা, ও শিমের চাষাবাদ শেখান। এ জন্য তিনি ‘স্বর্গীয় কৃষক’ নামে পরিচিত। ইয়াংদি ৩৬৫টি ঔষধি গাছের তালিকা প্রণয়ন করেন যার মধ্যে চীনা চায়ের কথা উল্লেখ ছিল। এ তালিকার সূত্র ধরে চীনে ভেষজশাস্ত্রের বুৎপত্তি ঘটে। এ জন্য তাঁকে ‘ভেষজ ঔষধের দেবতা’ও বলা হয়। সম্ভবত, নিজদেহে কোনো এক বিষাক্ত ভেষজের বিষক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পাঁচ সম্রাট- হোয়াংদি, ঝোয়াংসু, দিকু, ইয়াও এবং শুং
বর্তমান চীনের প্রধান জাতিগোষ্ঠী হ্যান (Han) কিংবদন্তী ‘লাল সম্রাট’ ইয়াংদি ও পাঁচ সম্রাটের একজন ‘হলদে সম্রাট’ হোয়াংদির বংশধর। হোয়াংহো নদীর তীরে হোয়াংদি আর ইয়াংসির তীরে ইয়াংদি বাস করত। হোয়াংদি যখন তিনি গজদন্তের রথে চড়ে বেড়াতেন তখন বাঘ, সিংহ, সাপ আর ফিনিক্স পাখিরা তাঁর সাথে সাথে ঘুরত। প্রয়োজন হলে তিনি মাঝে মধ্যে ঈশ্বরের সাথে কথাও বলতেন। চীনা সংস্কৃতির উন্মেষে হোয়াংদির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। চীনারা বিশ্বাস করে যে তিনি চীনে আইন ও সরকার ব্যবস্থার প্রচলন করেন, চীনাদেরকে চাকা, কম্পাস, নৌযান তৈরি শেখান এবং সঙ্গীত ও শিল্পকলায় দীক্ষিত করেন।
হোয়াংদির স্ত্রী লেই যু (Lei Zu) একদিন দুপুরে তাঁর বাগানে কোনো এক তুঁত গাছের নীচে বসে যখন চা পান করছিলেন তখন একটি রেশম গুটি তাঁর পেয়ালায় পড়ে। পেয়ালার গরম চায়ে গুটি থেকে ধীরে ধীরে রেশম সুতা বের হতে থাকে। এর পরে তিনি রেশম পোকার জীবন বৃত্তান্ত জানলেন এবং চীনা মহিলাদেরকে রেশম গুটি থেকে সুতা বের করা শেখালেন। পরবর্তীকালে রেশম সিল্কে চীনারা সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছিল। চীনাদের কাছে লেই যু আজো ‘রেশমকীটের মা’ (Silkworm Mother) হিসেবে পরিচিত।
একবার হলদে ও লাল সম্রাটের লোকজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধলো। বর্তমান বেইজিংয়ের কাছাকাছি বাংকোয়াং (Banquan) নামের কোনো এক স্থানে তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে হলদে সম্রাটের কাছে লাল সম্রাট পরাজিত হলেও দুই সম্রাটের মধ্যে একটি শান্তির সমঝোতা হয়। ফলে হলদে সম্রাটের নেতৃত্বে হলদে ও লাল জাতি একসাথে বসবাস করতে শুরু করে। এ দুই জাতির মিলবন্ধনে নতুন যে জাতিগোষ্ঠী তৈরি হয় এখন তারা হ্যান জাতিগোষ্ঠী নামে পরিচিত। বর্তমানে চীনাদের নব্বই ভাগের বেশী লোক হ্যান জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
‘ধ্রুবতারার দেবতা’ ঝোয়াংসু হলদে সম্রাটের নাতি। জ্যোতির্বিদ্যা ও দিনপঞ্জিতে পারদর্শী এ সম্রাট রাজা সলোমোনের মতো তিনি জ্বীন-ভূতের সাহায্যে রাজ্য পরিচালনা করতেন। চীনের মহাপ্লাবন শেষে ফুসি তাঁর বোন নোয়াকে বিয়ে করেছিল, যার ফলশ্রুতিতে চীনা সমাজে সহোদর বিবাহ রীতি প্রচলিত হয়। ঝোয়াংসু এ ধরণের বিবাহপ্রথা রদ করে। তিনি চীনের প্রভাবশালী কিং (Qing) রাজবংশের পূর্বপুরুষ।
চীনা সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র আবিস্কার করেছিলেন হলদে সম্রাটের প্রপৌত্র লোককাহিনীর পঞ্চম সম্রাট দিকু। ‘সাদা সম্রাট’, ‘দেব সম্রাট’ নামে অভিহিত দিকু চীনের শাং (Shang) ও চৌ (Chou/Zhou) রাজবংশের পূর্বপুরুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি বসন্ত-গ্রীষ্মে ড্রাগেন ও হেমন্ত-শীতে ঘোড়ায় চলাচল করতেন। দিকুর দ্বিতীয় স্ত্রী জিয়ানদি (Jiandi) একবার এক কালো পাখির ডিম গলাধঃকরণ করলে ঐ ডিমের প্রভাবে সে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। এই পুত্রসন্তান কি (Qi) শাং রাজবংশের দ্বিতীয় পিতৃপুরুষ। দিকু আরেক স্ত্রীর জিয়াং ইউয়াং (Jiang Yuan) কোনো এক দেবতার পায়ের ছাপের উপর পা দেবার কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, ফলে জন্ম নেয় হৌজি (Hou Ji) যিনি চৌ রাজবংশের পূর্বপুরুষ।
দেব সম্রাটের পুত্র ইয়াও তাঁর শাসনামলে ভয়াবহ এক খড়ার হাত থেকে চীনাদেরকে রক্ষা করেছিলেন। এ কাজে তাঁকে সাহায্য করেছিল হৌইয়ই (Houyi) নামের এক তীরন্দাজ। সে সময়ে দশটি জ্বলজ্বলে সূর্যের তাপদাহে ইয়াওয়ের সাম্রাজ্যের নদী-নালা-খাল-বিল সব শুকিয়ে যাচ্ছিল। সূর্যের এ ভয়াবহতা কমানোর জন্য হৌইয়ই তীর মেরে নয়টি সূর্যকে মাটিতে নামিয়ে আনেন। ইয়াও শাসনামলের অন্যান্য অবদানের মধ্যে ঋতুভেদে কৃষিকাজের সুবিধার্থে পঞ্জিকাবর্ষ সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। সম্রাট হিসেবে ইয়াও ছিলেন সুবিবেচক, ন্যায়পরায়ন ও মানবহিতৈষী। তিনি শহরের সামনে একটি কাঠের মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিলেন যেখানে দাড়িয়ে সাধারণ মানুষ তাঁর শাসনের দূর্বলতাগুলো তুলে ধরতে পারতেন। তিনি বলতেন, ‘রাজ্যের একটি মানুষও যদি ক্ষুধার্ত থাকে সেজন্য আমি দায়ী’।
সম্রাট ইয়াও শাসক হিসেবে এতটাই দায়িত্বশীল ছিলেন যে, তিনি যখন বুঝতে পারলেন তাঁর সন্তান ড্যাংঝু (Danzhu) যথাযথভাবে রাজ্য শাসনে অক্ষম তখন তিনি তাঁর রাজ্য অমাত্য শুংকে রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য নিজের দুই কন্যাকে তাঁর সাথে বিবাহ দিয়ে শুংয়ের রাজ্যাভিষেক করেন।
সম্রাট হিসেবে তো বটেই ব্যক্তি হিসেবেও শুং এতটাই দায়িত্বশীল ছিলেন যে সৎ মা, সৎ ভাইয়ের শত অত্যাচারের সহ্য করেও তিনি তাদের প্রতি নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যকে কখনও অবহেলা করেননি। শুং তাঁর সাম্রাজ্যকে বারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে পালাক্রমে সকল অঞ্চলে ভ্রমণ করে প্রজাদের সুখ দুঃখের খোঁজ-খবর নিতেন।
প্রজাদের ধর্মীয় উৎকর্ষের জন্য তিনি প্রতিটি অঞ্চলে স্ব-স্ব দেবতার পূজা-অর্চণা, উৎসর্গের স্থান নির্ধারণ আর ইয়াওয়ের মতো কৃষিকাজের সুবিধা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদী খনন করেছিলেন। সুবিচারক হিসেবেও শুংয়ের খ্যাতি ছিল। যখন কৃষকদের মধ্যে গোলযোগ দেখা দেয়, যখন মৎসজীবীরা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, কুমোর পাড়াতে মাটির বাসন-কোসন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল তখন তিনি কৃষক-জেলে-কুমোরদের সাথে মাসের পর মাস সময় কাটিয়ে তাদের সব সমস্যার সমাধান করেছিলেন।
চীনা তিন কিংবদন্তী ও পাঁচ সম্রাটের রূপকথা ও লোককাহিনী ঐতিহাসিক সময়কাল ৩৫০০-২০৭০ খ্রিঃপূঃ।
(ধারাবাহিকভাবে পৃথিবীর গল্প চলবে)
- পর্ব-০২: পৃথিবীর গল্প: চার সভ্যতার লীলাভূমি মেসোপটেমিয়া (সুমেরীয়-আকেদীয়-গুটি-সুমেরীয়)
- পর্ব-০৩: পৃথিবীর গল্প: চীনে এগারো শত বছরের শাসনে দুই রাজবংশ (শিয়া ও শাং রাজবংশ)
- পর্ব-০৪: পৃথিবীর গল্প: চার সভ্যতার লীলাভূমি মেসোপটেমিয়া (আসেরীয়া-ব্যাবিলনিয়া-হিটাইট-ক্যাসাইট-নব্য আসেরীয়া- নব্য ব্যবিলনীয়া)
- পর্ব-০৫: পৃথিবীর গল্প: ফারাও শাসনের উত্থান ও বিকাশ-ফারাও এবং কুশাইট শাসন
- পর্ব-০৬: পৃথিবীর গল্প: ফারাও শাসনের পুনরুত্থান-ফারাও-আকিমানিদ-আক্সুমাইট
- পর্ব-০৭: পৃথিবীর গল্প- আকিমানিদ-মেসিডোনিয়-জরথুস্ত্রবাদ-সিলুসিদ (পারস্য সভ্যতা-১)
- পর্ব-০৮: রোমক সভ্যতার উত্থানঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (১ম ভাগ)
- পর্ব-০৯: রোমক গণপ্রজাতন্ত্রঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (২য় ভাগ)
- পর্ব-১০: রোমক সাম্রাজ্যঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (৩য় ভাগ)
- পর্ব-১১: রোমক সাম্রাজ্যের পতনঃ রোমক সভ্যতার ইতিহাস (৪র্থ ভাগ)
- পর্ব-১২: বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন