ওম প্রতীক-অর্থ ও ব্যাখ্যা

ওম (ॐ) প্রতীক- বুৎপত্তি ও বিকাশ

হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম ও সর্বজনীন প্রতীক ॐ। উচ্চারণে ‘ওম’। বৌদ্ধ, জৈন ও শিখরাও ওম-কে পবিত্র জ্ঞান করে। হিন্দু মন্ত্র, প্রার্থনা ও ধ্যানের শুরুতে ও শেষে ওম উচ্চারণ করা হয়। যেহেতু এটি উচ্চারণ করে স্তব করা হয় তাই একে প্রণব বা ত্র্যক্ষর বলে। মন্দির, ঠাকুরঘর প্রভৃতি ধর্মীয় স্থানের প্রতীকচিহ্ন রূপেও ওঁ-কার ব্যবহৃত হয়। আজকাল ট্যাটু হিসাবেও এটি জনপ্রিয়।

ॐ শব্দটি ওঁ বা ‘ওম’ এর দেবনাগরী রূপ। দেবনাগরী লিপি ব্রাহ্মী পরিবারের আবুগিডা (abugida) লিপি। সংস্কৃত, হিন্দি, মারাঠি, বিহারি, মারওয়াড়ি, ভোজপুরি, নেপালি ভাষায় এ লিপির প্রভাব আছে। লিপিটা বাঁ-দিক থেকে ডান-দিকে পড়া হয়।

বেদ, উপনিষদ, গীতা ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রে সর্বত্রই ওঁ-কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তিনটি অক্ষরের (অ +উ +ম) সমন্বয়ে গঠিত এ ‘ওম’ শব্দ। খ্রিস্টানরা যেমন ‘পবিত্র ত্রয়’ (Holy Trinity- Father, Son, and Holy Spirit) এ বিশ্বাস করে তেমনি হিন্দুদের কাছে ‘ওম’ একটি ত্রিশক্তিবাচক শব্দ। তবে কী সেই ত্রয়ী শক্তিসমূহ তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। ওম সাধারণতঃ যে সকল ত্রয়ী শক্তির আধার বলে বিবেচিত তা হলো: (১) ত্রয়ী ভগবান- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব (সৃষ্টি, পালন ও সংহার); (২) ত্রিলোক- স্বর্গ, মর্ত্য ও ব্যোম; (৩) ত্রিশক্তি- (৩.১) চিন্তা, বাকশক্তি ও কর্ম, (৩.২) জ্ঞান, কর্ম ও সংকল্প, (৩.৩) বাক, মনন ও প্রাণ, (৩.৪) দেহ, আত্মা ও মন, (৩.৫) সত্য, সাহস ও সহানুভূতি; (৪) ত্রিগুণ- দয়া, আসক্তি ও ধ্বান্ত; (৫) ত্রয়ীবেদ- রিগবেদ, যোজুরবেদ ও সামবেদ; (৬) ত্রয়ী চেতনা- চেতন, অর্ধচেতন ও অবচেতন; (৭) ত্রিসময়- সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা; (৮) ত্রিঋতু- শতি, গ্রীষ্ম ও বসন্ত; (৯) অগ্নি, বরুণ ও বায়ু; (১০) ত্রিদেবী/মানবী- অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকা; (১১) ত্রিরং- লাল, সাদা ও কালো; (১২) ত্রিসময়- অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত; (১৩) ত্রয়ী অবস্থান- জন্ম, মৃত্যু ও জীবন ইত্যাদি ইত্যাদি। বৌদ্ধ ধর্মে ত্রিশক্তি হলো বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ।

‘ওম’ প্রতীকটির এটি সাংকেতিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। তিনটি বাঁক (curve), একটি বিন্দু (dot) ও একটি উপবৃত্তের (semicircle) সমন্বয়ে এ প্রতীকটি গঠিত। নিচের বৃহৎ বাঁকটি (১) মানুষের জাগ্রত চেতনা, উপরের বাঁকটি (২) সুশুপ্তি বা অচেতন এবং মাঝের বাঁকটি (৩) স্বপ্ন বা অবচেতনকে নির্দেশ করে। এভাবে তিনটি বাঁক মানুষের তিনটি চেতনাকে নির্দেশ করে যার সাথে সিগমন্ড ফ্রয়েডের ‘মনের ত্রিস্তর’ (Three Levels of Mind) ধারণার সাথে মিল রয়েছে।

সংস্কৃতে বিন্দুটিকে (৫) বলে ‘তুরিয’ (turiya), যার অর্থ চতুর্থ। এই চতুর্থ চেতনা হলো ‘শুদ্ধ চেতনা’। এ শুদ্ধ চেতনার পটভূমিতে অন্য চেতনাত্রয় প্রভাবিত, আলোকিত ও শ্রেষ্ঠতর হয়ে ওঠে। অর্ধবৃত্তটির (৪) নাম মায়া। এই মায়া শুদ্ধ চেতনাকে অপরাপর সকল চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, মোক্ষলাভে বাঁধা হয়ে দাড়ায়।

সম্পর্কিত অন্যান্য ব্লগ