শিল্প-সাহিত্যে স্বকাম বোঝার জন্য একটু ইংরেজির সহায়তা প্রয়োজন। ইংরেজি ‘ম্যাসটারবেইশন’ শব্দের প্রচলিত বাংলা প্রতিশব্দের যুক্তাক্ষর বা ঐ-কার শব্দটির আয়তন যতটা বাড়িয়েছে শ্রতিকটুতা ততটা কমাতে পারেনি। তাই ‘হস্ত’ রেখে শব্দমৈথুন করে ‘স্বকাম’ নিয়ে এগুতে হলো। এটাই শিল্প। দেখার চোখ ও বোঝার চোখের মধ্যে যেটুকু ফাঁকি দিয়ে ততটুকুই শিল্পের পরিব্যাপ্তি। শিল্পীরা এখানেই আমাদের থেকে ভিন্ন। তারা ভিন্ন কিছু দেখে না, সাধারণ বিষয়কে ভিন্নভাবে অনুধাবন করে।
চিত্র, স্থাপত্য ও সাহিত্যের বিষয়বস্তু হিসেবে শিল্পীরা তাদের শিল্পে একেক সময়ে একেক ভাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে স্বকাম প্রকাশ করেছে। স্বকাম নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত দু’টি চিত্রকর্মের চিত্রকরের নাম সালভাদর ডালি (Salvador Dalí, ১৯০৪-১৯৮৯)। অধিবাস্তববাদ বা সুরিয়েলিজমকে (surrealism) ভিত্তি করে আঁকা চিত্র যখনি কোন আলোচনায় আসে, সবার প্রথমে সালভেদর ডালির নামটি প্রাধান্য পায়। অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন এ স্প্যানিস চিত্রকর।
১৯২৯ সালে ডালি প্রথমবারের মতো একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এ প্রদর্শনীতে অন্যান্য ছবির সাথে ‘দ্য লুগুব্রিয়াস গেম’ (The Lugubrious Game, 1929) বা ‘বিষণ্ন ক্রীড়া’ ও ‘দ্য গ্রেট ম্যাসটারবেটর’ (The Great Masturbator, 1929) বা ‘মহান স্বকামী’ নামে দুটি চিত্রশিল্পও প্রদর্শিত হয়। এ দুটি চিত্রশিল্পেরই বিষয়বস্তু ছিল স্বকাম। ডালির স্বকামী চিত্রকর্মের মূলে ছিল তাঁর জেনোফোবিয়া (Genophobia) বা যৌনভীতি।
ডালির হিটলার প্রীতি ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, যে উপায়ে হোক না কেন, মনুষ্য সমাজে যুদ্ধ ও একনায়কতন্ত্রের প্রয়োজন আছে। জীবনের শেষ দিকে এসে হিটলার স্মরণে একটি তিনি অসাধারণ আরেকটি ছবি আঁকেন। ১৯৭৩ সালে আঁকা এ চিত্রকর্মের নাম ‘স্বকামী হিটলার’ (Hitler Masturbating, 1973)।
ডালির আগে স্বকাম নিয়ে খ্যাত বেশ কিছু চিত্রকর্ম উপহার দিয়েছিলেন অস্ট্রিয়ান গুস্তাভ ক্লিমট (Gustav Klimt, ১৮৬২-১৯১৮)। নারীর স্বকাম নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর করা স্কেচের সংখ্যাই সবচে’ বেশী। এদের মধ্যে অন্যতম দু’টি হলো ‘স্বকাম’ (Masturbation, 1913) এবং ‘স্বকামী বালিকা’ (Masturbating Girl, 1916)। পর্নোগ্রাফিক চিত্রশিল্পের জন্য ক্লিমট সে সময়ে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিল।
ডালির পরে আরেক বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রকর পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩) স্বকাম নিয়ে চিত্র এঁকেছিল। নারীর স্বকাম নিয়ে অঙ্কিত এ চিত্রটির নাম ‘লে রেভ’ (Le Rêve, 1932) বা ‘স্বপ্ন’। অনেকে মনে করেন যে, স্বকামের অপকারিতা বোঝাতে তিনি এ চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন।
মধ্যযুগে মানব দেহে স্বকামের নেতিবাচক প্রভাবকে তুলে ধরে নির্মিত বিখ্যাত একটি স্থাপত্য শিল্পের নাম ‘ডেভিড’ (১৫০১-১৫০৪)। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম সব ধর্মে ঐশ্বরিক দূত হিসেবে ডেভিডের উল্লেখ আছে। রেনেসা প্রভাবিত প্রখ্যাত ইতালিয় শিল্পী মাইকেলাঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪) এ মূর্তিটি নির্মাণ করেন। মূর্তিটি বর্তমানে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের ‘গ্যালেরিয়া ডেলাকাদেমিয়া’তে স্থাপিত রয়েছে। (হ্যাপেহ তত্ত্ব১)
মাইকেলাঞ্জেলোর মতো স্বকামের নেতিবাচক প্রভাবকে তুলে ধরে নির্মিত আরেকটি একটি স্থাপত্য শিল্পের নাম ‘লে পেনসুর’ (Le Penseur) বা ‘ভাবুক’ (The Thinker, 1879-1889)। দশ বছর ধরে ব্রোঞ্জের এ মূর্তিটি তৈরী করেছিলেন ফরাসি শিল্পী অগাস্ট রডিন (১৮৪০-১৯১৭)। বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘ভাবুক’ মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়েছে। (হ্যাপেহ তত্ত্ব*)
স্বকাম নিয়ে ‘On Masturbation’ নামে মার্ক টোয়েন একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ‘ইলিয়ড’-এ হোমার বলেছিলেন, “Give me masturbation or give me death!”। কথায় কথায় যে রবিনসন ক্রশোকে আমরা আউড়াই স্বমেহন নিয়ে তাঁর বক্তব্য হলো, ‘এই ভদ্রোচিত শিল্পের কাছে আমি কতটা ঋণী তা বোঝাতে পারবো না’। সতীত্বে খ্যাত কুইন এলিজাবেথ মনে করতেন ‘স্বকাম সতীত্ব রক্ষার উপায়’। তবে মজার ব্যাপার হলো মার্ক টোয়েন “If you must gamble away your life sexually, don’t play a Lone Hand too much” বলে তাঁর নিবন্ধ শেষ করেছিল।
——
১। শিল্পের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ফোরামের (SciForums) স্বকাম ও সমকামীতার গোঁড়া সমর্থক এক সদস্যের নাম হ্যাপেহ। তিনি স্বকামীতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিখ্যাত বেশ কিছু শিল্পের অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। তাঁর এ সকল আলোচনা ‘হ্যাপেহ তত্ত্ব’ (Happeh Theory) নামে পরিচিত।
প্রথম প্রকাশকাল– ২৬ জুলাই ২০১৭