বাংলার-বাদ্যযন্ত্র-একটি-সংক্ষিপ্ত-পরিচিতি

বাংলার বাদ্যযন্ত্র ও সঙ্গীত বাংলা সংস্কৃতির সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলার বাদ্যযন্ত্র চার ভাগে বিভক্ত। (১) ততবাদ্য, (২) শুষিরবাদ্য, (৩) আনদ্ধ বাদ্য, ও (৪) ঘনবাদ্য।

যেসব বাদ্যযন্ত্রে তার থেকে ধ্বনি উৎপত্তি হয় তাকে তত্‍বাদ্য বলে। এদের মধ্যে কিছু অঙ্গুলি, মিজরার দ্বারা আঘাতের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি করে; যেমন- বীণা, সেতার, তানপুরা, সরোদ ইত্যাদি। অন্যগুলোতে ছড়ি বা ছড় বা ধনু দ্বারা আঘাত বা ঘর্ষণের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি হয়; যেমন- বেহালা, সারেঙ্গী, দিলরুবা ইত্যাদি।

শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশ, কাঠ বা অন্য প্রকার ধাতব পদার্থ দিয়ে বানানো হয়। হাওয়া, মুখের ফু দ্বারা ধ্বনির উৎপত্তি করা হয় তাকে শুষির বাদ্যযন্ত্র বলে; যেমন- সানাই, বাঁশি ইত্যাদি।

যেসব বাদ্যযন্ত্র চামড়া দ্বারা আচ্ছাদিত এবং চামড়ার উপর আঘাতের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি হয়, তাকে আনদ্ধ বাদ্য বলে; যেমন— তবলা-বাঁয়া, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ ইত্যাদি।

ঘনবাদ্য ধাতুনির্মিত অর্থাৎ পিতল, কাঁসার তৈরি। আঘাতের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি হয়। ঘনবাদ্য দু’রকমের অনুরক্ত এবং বিরক্ত। যে ঘনবাদ্য সঙ্গীতে ব্যবহার করা হয় তা হলো অনুরক্ত; যেমন- করতাল, মন্দিরা, জলতরঙ্গ ইত্যাদি। যে ঘনবাদ্য পূজানুষ্ঠান ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় তা বিরক্ত; যেমন- ঘণ্টা, কাঁসর ইত্যাদি। 

ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র

বাংলার বাদ্যযন্ত্র- ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র

ঢোলঃ ঢাকের চেয়ে আকারে ছোট। চর্মাচ্ছাদিত এই যন্ত্রটির ব্যবহার অধিক। সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় তালবাদ্য হিসেবে ঢোলের ব্যবহার ব্যাপক। 

ঢোলকঃ  ঢোলক হচ্ছে ঢোলের ক্ষুদ্র সংস্করণ। এটি মেয়েলি গীত, খেমটা নাচ-গান এবং কোন কোন ভিক্ষোপজীবীর গানে ব্যবহূত হয়। ঢোল ও ঢোলক প্রয়োজন অনুযায়ী বসে বা দাঁড়িয়ে বাজানো যায়।

মাদল বা মৃদঙ্গঃ  মাটির খোলের তৈরি স্থূলাকার একটি যন্ত্র। পল্লী অঞ্চলে উৎসবের সময় এটি বাজানো হয়। আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে এবং ঝুমুর নাচ-গানে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা হয়।

ঢাকঃ  আনদ্ধ জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ঢাক প্রধান। ঢাকের ব্যবহার অতি প্রাচীন। বড় আকারের কাঠের খোলের উভয় মুখে পুরু চামড়ার ছাউনি দিয়ে ঢাক তৈরি করা হয়। খোলটি আনুমানিক এক হাত ব্যাস ও দুই হাত দীর্ঘ হয়ে থাকে। মোটা ফিতার সাহায্যে বাম কাঁধে কোল বরাবর ঝুলিয়ে দুই হাতে কাঠির সাহায্যে এটি বাজাতে হয়।

ডুগডুগিঃ  শিবের গাজন,  সাপখেলা, বানরনাচ ও ভল্লুকের খেলায় ডুগডুগি ব্যবহূত হয়। এর বড় সংস্করণের নাম বিষম ঢাকি। দুটির মধ্যে পার্থক্য হলো, ডুগডুগির মতো এতে গুলতিযুক্ত সুতা বাঁধা থাকে না এবং খাড়াখাড়িভাবে রেখে হাতের তালু ও তর্জনী দিয়ে এটি বাজাতে হয়। একে ডমরুও বলে।

ডুগিঃ এক ধরনের ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র যা, কেটলির আকৃতির মতো। এটি আঙ্গুল ও হাতের তালু দিয়ে বাজাতে হয়। এটি বাংলাদেশি বাউল সম্প্রদায়রা তাদের বাউল গানে ব্যবহার করে। 

পাখোয়াজঃ  ‘পাখোয়াজ’ শব্দটি ফারসি শব্দ ‘পাখ-আওয়াজ’ (যা থেকে পবিত্র ধ্বনি নিঃসৃত হয়) থেকে গৃহীত হয়েছে। আনদ্ধযন্ত্র শ্রেণির যন্ত্রের মধ্যে পাখোয়াজ উল্লেখযোগ্য। এটি প্রাচীন মৃদঙ্গ থেকে সৃষ্ট এবং কাঠের তৈরি। এর আওয়াজ মধুর ও গম্ভীর। মৃদঙ্গের সঙ্গে পাখোয়াজের আকৃতিগত পার্থক্য আছে।

তবলা ও বাঁয়াঃ তবলা এক ধরনের দুই অংশ বিশিষ্ট চর্মাচ্ছাদিত ঘাতবাদ্য যন্ত্র। দুই অংশের মধ্যে ডান হাতে বাজাবার অংশটির নাম ডাহিনা (ডাইনা, ডাঁয়া) বা তবলা এবং বাঁ হাতে বাজাবার অংশটির নাম বাঁয়া বা ডুগি। 

নাগারাঃ এক প্রকার বড় ঢাক। এটি প্রাচীন রণবাদ্যবিশেষ। একে দামামাদুন্দুভি নামেও ডাকা বলে।

খঞ্জরিঃ  আনদ্ধ জাতীয় তালবাদ্যযন্ত্র। নিম বা  কাঁঠাল কাঠের তৈরি একটি পাতলা চাকতির এক পাশ চামড়া দিয়ে ছাওয়া হয়, অপর পাশ থাকে খোলা। চাকতির গায়ে সমান দূরত্বে কয়েকটি ছিদ্র করে একাধিক ধাতব পাত লাগানো হয়। যন্ত্রটি বাজানোর সময় এগুলি থেকে ঝনঝন ধ্বনি ওঠে।

চামড়ার ওপর কখনও আঙ্গুলের টোকা দিয়ে, কখনও বা তালুর আঘাতে তাল সঙ্গত করা হয়। এদিক থেকে খঞ্জরিকে আনদ্ধ ও ঘন বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রিত রূপ বলা যায়। ধাতব পাত থেকে ঝনঝন এবং চামড়ার ছাউনি থেকে ঠপঠপ ধ্বনি সৃষ্টি হয়। বড় আকারের খঞ্জরি ‘ডফ’ বা ‘ডম্ফ’ নামে পরিচিত।

বাঁশি জাতীয় বাদ্যযন্ত্র

বাংলার বাদ্যযন্ত্র- বাঁশি জাতীয় বাদ্যযন্ত্র

আড়বাঁশিঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণের মোহনবাঁশিকে আড়বাঁশি বলা হয়ে। এ বাঁশির ওপর গাঁট বন্ধ থাকে। এর মুখরন্ধ্র আঁড়ভাবে ধরে ঠোঁট খানিকটা বাঁকিয়ে ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়। একে অনেক জায়গায় মুরলীও বলা হয়। আঁড়বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার ছিদ্রটি বাঁশির শেষ প্রান্তে না করে প্রায় দুই ইঞ্চি ভেতরে বাঁশির গায়ে করা হয়।

বাজানোর সময় এই ছিদ্রটি দুই ঠোঁটের কাছে নিয়ে ফুঁ দিতে হয়। এই বাঁশিতে স্বরস্থানে ছয়টি ছিদ্র থাকে। এটা খাড়া করে ধরা হয় না। অনেকটা মাটির সঙ্গে সমান্তরাল করে মুখ ও দেহের ডানদিকে প্রসারিত করে পাশাপাশি ধরে বাজানো হয়।

কদবাঁশিঃ কদবাঁশির বাঁশির মাথা তেরছাভাবে কেটে কাঠের পাতলা খিল আঁটা হয় এবং সেখানে ঈষৎ ছিদ্রপথে ফুঁ দিলেই এটি বাজে। এর নিচে চার কোনাকার একটি উন্মুক্ত বায়ুরন্ধ্র থাকে। অঞ্চলভেদে কদবাঁশির বিভিন্ন নাম আছে, যেমন: মুখের মধ্যে পুরে বাজাতে হয় বলে উত্তরবঙ্গে ‘মুখাবাঁশি’, মুখের কাছে খিল থাকে বলে ফরিদপুরে ‘খিলবাঁশী’ এবং মুখ কলমের মতো দেখায় বলে ‘কলমবাঁশি’ বলা হয়। আদিবাসীরা একে বলে ‘লয়বাঁশি’।

টিপরাবাঁশিঃ টিপরাবাঁশির উভয় মুখ খোলা এবং এতে আটটি ছিদ্র থাকে। কদবাঁশির মতো মাথায় ফুঁ দিয়ে এটি বাজানো হয়; তবে উভয় প্রান্ত খোলা থাকে বলে এর বাদনে বিশেষ কৌশল ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।

হরিণাবাঁশিঃ হরিণাবাঁশি প্রকৃতপক্ষে হরিণ শিকারের বাঁশি। প্রায় এক ফুট দীর্ঘ এ বাঁশির উভয় প্রান্ত খোলা এবং গায়ে কোন ছিদ্র থাকে না। এতে ফুঁ দিলে হরিণশিশুর ডাকের মতো আওয়াজ হয়; এ থেকেই এর নাম হয়েছে হরিণাবাঁশি।

সরলবাঁশিঃ সরলবাঁশিও মুখে পুরে সোজাসুজি ধরে বাজানো হয়। এর মুখের ছিদ্রের কাছে আর একটি বায়ূরন্ধ্র বা ছিদ্র থাকে যেখান দিয়ে বায়ু নির্গত হয়ে সুরের উপর প্রভাব ফেলে।

পাতবাঁশিঃ শুধু গাছের পাতা মুখে পুরে সামান্য বাঁকা করে হাতে ধরে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়। দক্ষ বাদক এর সাহায্যে গানের সুর পর্যন্ত তুলতে পারে। তালপাতার তৈরি এক ধরণের পাতবাঁশির প্রচলন রয়েছে।

বীণঃ তুবড়ি যন্ত্রের আঞ্চলিক নাম ‘বীণ’। এটি প্রধানত সাপুড়েরা সাপধরা ও সাপখেলার কাজে ব্যবহার করে। তাই এর অন্য নাম ‘নাগিন বীণ’।

শঙ্খ বা শাঁখঃ শঙ্খ বা শাঁখ একটি অতি পরিচিত শুষির (বাতাসের সাহায্যে বাজে ) যন্ত্র। সমুদ্র থেকে আহূত শঙ্খের ভেতর-বাইর পরিষ্কার করে এবং তার নাভি কেটে সেখানে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়। শঙ্খ হিন্দুদের পূজা-পার্বণ, বিবাহ ইত্যাদি মাঙ্গলিক ও প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান এবং সঙ্কেতজ্ঞাপনে ব্যবহূত হয়।

এছাড়া শাঁখ ও ঘণ্টা বাজিয়ে সন্ধ্যারতি এবং গৃহে প্রবেশের পূর্বে নতুন বর-বধূকে শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করা হয়। প্রকৃতিদত্ত এ বাদ্যযন্ত্রটির ব্যবহার বহু প্রাচীন বলে মনে করা হয়।

শিঙ্গা, শৃঙ্গ বা পেঁপাঃ মহিষ-শৃঙ্গের অবয়ববিশিষ্ট একটি শুষির যন্ত্র। অতীতে মহিষের শিং থেকে এটি তৈরি হতো; বর্তমানে ধাতু নির্মিত শিঙ্গা ব্যবহূত হয়। শিবের ত্রিশূলের গায়ে ডমরু ও শিঙ্গা ঝুলতে দেখা যায়। এককালে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা শিঙ্গা ব্যবহার করতেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে শিরালিরা মন্ত্রপাঠ করে ও শিঙ্গা বাজিয়ে মেঘ তাড়াতে ও শিলাবৃষ্টি রোধ করতো। প্রাচীনকালে শিঙ্গা যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র ছিল, একে বলা হতো রণশিঙ্গা।

বড় আকারের শিঙ্গাকে বলা হয় রামশিঙ্গা; এগুলি পেতল বা তামার তৈরি। রামশিঙ্গা অতি প্রাচীন যন্ত্র। ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো দীর্ঘ এর অবয়ব। এটিও অতীতে রণক্ষেত্রে বাজানো হতো। ভারতের অসম রাজ্যে একে পেঁপা বলে।

ভেরীঃ ভেরী পেতলের তৈরি বাঁশি জাতীয় যন্ত্র; পূর্বে রণক্ষেত্রে ব্যবহূত হতো।

ভেঁপুঃ ভেঁপু অঙ্কুর গজানো আমআঁটির খোসা ছড়িয়ে জোড়াবিচি তেরছাভাবে সামান্য ঘষে তৈরি করা হয়। তেরছা অংশ মুখে পুরে ফুঁ দিলে পুঁ পুঁ ধ্বনি সৃষ্টি হয়, এ থেকেই এর নাম হয়েছে ভেঁপু। গ্রামের শিশুদের এটি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র।

সানাইঃ সানাই এক প্রকারের বাদ্যযন্ত্র। দুই রিড যুক্ত বংশী শ্রেণীর লোকফুৎকার বাদ্য সানাই কাঠের তৈরি এবং দেখতে অনেকটা ধুতুরা ফুলের মতো। ওপরের দিক চিকন নিচে দিক ক্রমশ চওড়া। লম্বায় দেড় ফুটের মতো। লোকবাদ্য সানাই বর্তমানে রাগসঙ্গীতযন্ত্র হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

তার আশ্রিত বাদ্যযন্ত্র

বাংলার বাদ্যযন্ত্র- তার নির্মিত বাদ্যযন্ত্র

একতারাঃ বাঙালির লোকজ বাদ্যযন্ত্র। এক তার বিশিষ্ট বলে একে একতারা বলা হয়। এটি বাংলা লোকগীতির সাথে বহুল ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র।

সুরবাহারঃ সুরবাহার হচ্ছে সেতারের মতো দেখতে একটি তারযন্ত্র। এটা বেইজ সেতার হিসাবেও পরিচিত। উত্তর ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এর ব্যবহার হয়।

তানপুরাঃ তানপুরা বাদ্যযন্ত্রটি পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলে দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে বসনিয়া হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া এবং সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং ভারত । ভারত ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে এটি ল্যূট জাতীয় প্লাক যন্ত্র হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু ভারতে এটা দেখতে অনেকটা সেতারের মতো আকৃতির ।

এস্রাজঃ এস্রাজ মূলতঃ ভারতীয় উপমহাদেশেই ব্যবহৃত হয়। বলা হয় এস্রাজ সিতার ও সারেঙ্গীর সমন্বিত রূপ। এস্রাজের ব্যবহার দেখা যায় মূলতঃ পূর্ব ও মধ্য ভারতে এবং বাংলাদেশে । এটি তারের ওপর ছড় টেনে বাজাতে হয়। মূলতঃ সঙ্গতকারী যন্ত্র হিসেবেই এস্রাজ ব্যবহৃত হলেও এটিতে পূর্ণ গানের সুর তোলা সম্ভব।

বেহালাঃ বেহালার ইংরেজী নাম ভায়োলিন। বেহালার উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ বেহালাকে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র, কেউ কেউ আরব যন্ত্র, কেউবা ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র বলে থাকেন। ভারতীয় মতে, বেহালার উদ্ভব হয়েছে রাবনের আমল থেকে।

বাংলার বাদ্যযন্ত্র- তার নির্মিত বাদ্যযন্ত্র-২

সেতারঃ উত্তর ভারতীয় সংগীতে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। এতে প্রধান তারের সংখ্যা সাত। মোগল সম্রাজ্যের শেষদিকে উপমহাদেশে সেতারের প্রচলন হয়। সঙ্গীত সুদশর্ণা গ্রন্থে বলা আছে যে,অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফকির আমীর খসরু সেতারের আবিষ্কার করেন। এই ফকির আমীর খসরু তানসেনের বংশধর।

সারিন্দাঃ বাংলাদেশের গ্রামীণ লোকসমাজে সারিন্দা জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। সারিন্দা ছড়ের সাহায্যে বাজাতে হয়। ছড়টি দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো। ছড়ে ঘোড়ার লেজের চুল ব্যবহার করা হয়। পটরির ওপর বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে তার টিপে ডান হাতে ছড় টেনে সারিন্দা বাজানোর নিয়ম। ঢাকা এবং ঢাকার নরসিংদী অঞ্চলের সারিন্দা উল্লেখযোগ্য।

সরোদঃ সরোদ উপমহাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাসিকাল বাদ্যযন্ত্র। কারো কারো মাতে সরোদ মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের একটি একই ধরনের যন্ত্র আফগান রুবাব থেকে উদ্ভূত। বাংলাদেশে যে ক’জন অসাধারণ সরোদ শিল্পী জন্মেছেন তার মধ্যে রয়েছেন প্রায়ত আলি আকবর খান ও জীবিত খ্যাতিমানদের অন্যতম হচ্ছেন উপমহাদেশের বরেণ্য সুর সাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খার পৌত্র শাহাদাত হোসেন খান।

সন্তুরঃ এ জাতীয় বাদ্যযন্ত্রে তারের সংখ্যা ২৪ থেকে ৩০ বা তারও বেশী হতে পারে। একে শততন্ত্রী বীণাও বলা হয়। যেমনঃ এক তার হলে একতারা, দুই তারে দোতারা- এভাবে শত তারে শততন্ত্রী।

আনন্দ লহরীঃ অন্য নাম গুবগুবী, খমক। বস্তু তাড়িত অধাতব তত বাদ্যযন্ত্র। অনুষঙ্গী যন্ত্র। একক-বাদনের চল নেই। এই যন্ত্রটি বাঙালি লোকজ বাদ্যযন্ত্র।

সারেঙ্গীঃ সারেঙ্গী লোক যন্ত্ররূপে অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি বাদ্যযন্ত্র। কণ্ঠসঙ্গীতের বা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের গায়কের সাথে এই যন্ত্রটি সহযোগী যন্ত্র হিসাবে অতি সুপরিচিত। সপ্তদশ শতক থেকে সারেঙ্গী রাগ সঙ্গীতের যন্ত্ররূপে প্রচলন লাভ করে। স্থানভেদে সারেঙ্গীর আকারেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বিশ শতকের প্রথম দিকে সারেঙ্গী একক রাগ সঙ্গীত যন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ধাতু নির্মিত বাদ্যযন্ত্র

বাংলার বাদ্যযন্ত্র- ধাতু নির্মিত বাদ্যযন্ত্র

করতালঃ করতাল পেতলের তৈরি থালার আকৃতিবিশিষ্ট একটি যন্ত্র; এর বাদনরীতি জুড়ির মতোই। করতালের সুতা বা দড়ি তর্জনীতে জড়িয়ে হাতের তালুতে চাপ ও ছাড় দিয়ে এটি বাজাতে হয়। হাতের এই চাপ-ছাড়ের ওপরই করতালের ধ্বনির উচ্চতা ও মৃদুতা নির্ভর করে। কীর্তনে খোলের অনুষঙ্গ হিসেবে করতাল অপরিহার্য যন্ত্র। ‘যত ছিল নাড়াবুনে, হল সব কীর্তনে/ কাস্তে ভেঙ্গে গড়ায় কত্তাল।’ এই প্রবাদে কীর্তনে করতালের গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছে। অঞ্চলবিশেষে এটি খঞ্জনি নামেও পরিচিত।

জুড়িঃ জুড়ি কংসনির্মিত দুটি বাটি। এর মাঝখানে ছিদ্র করে মোটা সুতায় বেঁধে দুহাতে ধরে পরস্পরের মুখে টোকা দিয়ে বাজানো হয়। বাটির গা স্পর্শ করা যায় না; কারণ তাতে জুড়ির ধ্বনি অস্পষ্ট ও বিকৃত হয়। জুড়ি একাধারে তাল, লয় ও ছন্দ নিরূপণে সাহায্য করে। লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে জুড়ির ব্যবহার আছে। বৈষ্ণব বৈরাগীরা জুড়ি বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করে। জুড়ির অপর নাম মন্দিরা। এটি কাঁসার তৈরি; আকৃতি ছোট বাটির মতো। দুটি বাটি পরস্পরের আঘাতে বাদিত হয়। তাল, লয় ও ছন্দ নিরূপণে মন্দিরা বিশেষ উপযোগী।

খড়তালঃ খড়তাল জোড়-ধরা দুটি কাঠের ফ্রেম; অনেকটা ছুতার মিস্ত্রির রেঁদার মতো দেখতে। একই হাতের আঙ্গুলে ধরে এটি বাজাতে হয়। ভজনাদি গানে তালবাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার আছে।

প্রেমজুড়িঃ প্রেমজুড়ি তাঁতযন্ত্রের মাকুর আকৃতিবিশিষ্ট কাঠের দুফালি টুকরার সাহায্যে নির্মিত হয়। হাতের আঙ্গুলে ধরে পরস্পরের গায়ে আঘাত করে এটি বাজাতে হয়। কাঠের ফ্রেমের ভেতরে লোহার ছোট ছোট গুটি ভরা থাকে; এতে কাঠ ও ধাতুর মিশ্রধ্বনি সৃষ্ট হয়। অঞ্চলবিশেষে এটি খুনজুড়ি ও চটি নামেও পরিচিত। জিকির, কেচ্ছা, ফকিরালি প্রভৃতি গানে প্রেমজুড়ি ব্যবহূত হয়।

তালঃ তাল কাঁসার তৈরি একটি বাদ্যযন্ত্র। দুটি গোলাকার তাল পরস্পরের সঙ্গে আঘাত করে এই যন্ত্র বাজানো হয়।

জলতরঙ্গঃ জলতরঙ্গ কতগুলি চীনা মাটির বাটির সমন্বয়ে তৈরি। বিভিন্ন আকারের বাটিগুলি বড় থেকে ছোট ক্রমানুসারে সাজিয়ে তাতে পানি ভরে সুর নির্ধারণ করা হয় এবং দুটি কাঠির সাহায্যে বাটিতে আঘাত করে বাজানো হয়। এটি গানের অনুষঙ্গে অথবা এককভাবেও বাজানো যায়।

নূপুরঃ নূপুর চরণবাদ্য। পেতল বা তামার তৈরি বক্রাকার ফাঁপা নল দিয়ে এটি তৈরি হয়। এটি মলের মতো করে পায়ে পড়তে হয়। নূপুর প্রধানত নাচের তালবাদ্য।

ঘুঙুরঃ ঘুঙুর পেতলের ছোট ছোট এক গুচ্ছ বল বা ঘণ্টা মোটা সুতায় গেঁথে তৈরি করা হয়। এটিও একটি চরণবাদ্য এবং পায়ের গোড়ালির ওপরে পরা হয়। প্রধানত নাচের তালবাদ্য হিসেবে ঘুঙুরের ব্যবহার আছে, তবে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সার্কাসের জোকার, বহুরূপী, ফেরিওয়ালা ও খেমটাওয়ালারাও ঘুঙুর ব্যবহার করে।

কাঁসরঃ কাঁসর কংসনির্মিত ঈষৎ কানাতোলা থালার আকৃতিবিশিষ্ট একটি বাদ্যযন্ত্র। এর এক প্রান্তে দুটি ছিদ্র করে দড়ি বেঁধে বাঁহাতে ঝুলিয়ে ডান হাতে কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। হিন্দুদের পূজামন্ডপে ঢোলের সঙ্গে কাঁসরও বাজে। আকারে ঈষৎ ছোট অনুরূপ যন্ত্রকে বলে কাঁসি। এর ধ্বনি অপেক্ষাকৃত তীব্র। বিভিন্ন লোকসঙ্গীতে ঢোলের সঙ্গে কাঁসি বাজানো হয়।

এছাড়া, বাংলায় ব্যবহৃত আধুনিক বাদ্যযন্ত্র শ্রেণিতে হারমোনিয়াম, গিটার ইত্যাদি রয়েছে। হারমোনিয়াম এক ধরণের শুষির যন্ত্র। সংযু্ক্ত বেলোর সাহায্যে বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো রিড চালনা করে এটি বাজানো হয়। গিটার  ছয় তারবিশিষ্ট তত জাতীয় যন্ত্র। এটি দেখতে প্রায় বেহালার মতো, তবে আকারে বেহালার চেয়ে বড়। গিটার দুই প্রকার স্প্যানিশ ও হাওয়াইন। বর্তমানে সঙ্গীতক্ষেত্রে এটি বেশ জনপ্রিয় একটি বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রটি একক বা ঐকতানে বাদিত হয়; গানের সঙ্গে রাগালাপেও এটি ব্যবহূত হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন