সিফিনের যুদ্ধ

হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) বিষের প্রতিক্রিয়ায় মারা যান।

কে তাঁকে বিষ দিল? কি বিষে তিনি মারা গেলেন?  হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় নাতি (যার ঠোঁটে তিনি চুমু খেতেন, পিঠে চড়াতেন, কোলাকুলি করতেন) ও ‘জান্নাতে যুবকদের সর্দার’ কেন বিষপ্রয়োগে মারা গেলেন? কি ছিল সেই ঘটনার পেছনের ঘটনা?

এসব জানতে প্রথমে বেশ কিছু বক্তার ভিডিও দেখি। গোটা দশ বারো জনের বয়ানের ভিন্নতা, তথ্যের কারচূপি, আবেগি ও রসালো তথ্য দেখে যথেষ্ট মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি। ইসলামের এতবড়ো একটা ইতিহাস এভাবে জনে জনে ভিন্ন হতে পারে না। তাদের কথাবার্তার অসংলগ্নতা দেখে নিজে পড়তে শুরু করি।

এ বিষয়ে আমার অন্যান্য বই, তথ্য পড়ার পাশাপাশি যে দুটি রেফারেন্সের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন সে দুটির একটি হলো ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ সংকলনের অষ্টম খণ্ড। দ্বিতীয়টি হলো ২০১৬ সালে Medicine, Science and the Law জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র। নাম- A forensic hypothesis for the mystery of al-Hasan’s death in the 7th century: Mercury(I) chloride intoxication। গবেষণা করেছেন মার্কিন Nashua Community College অন্তর্গত Science and Engineering Technology Department এর Nicole Burke, Mitchell Goals ও Aliyar Mousavi এবং Golden Gate University School of Law এর Cyrus L. Raafat। গবেষণায় ব্যবহৃত পুস্তক ও অন্যান্য সহকারীগণের রেফারেন্স সেখানেই উল্লেখ করা হয়েছে।

বিভিন্ন উৎস থেকে এ ঘটনার আদ্যোপান্ত পড়ে বুঝতে পারি, এটা কোন সাধারণ বিষক্রিয়া নয়। হয়তো এটা একটা ষড়যন্ত্র। এ ঘটনার সাথে সে সময়ের ক্ষমতার রাজনীতি জড়িত। তাই এ ঘটনা বুঝতে হলে পাঠকদের তখনকার ইসলামী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু ধারণা থাকতেই হবে।

মারা যাওয়ার সময়ে হাসান (রাঃ) এর বয়স সম্ভবত ৪৭ বছর (ভিন্নমতে ৪৫, ৪৯) ছিল। সময় ৬৭০ সালের কাছাকাছি। এর প্রায় ৯-১০ বছর আগে খেলাফায়ে রাশেদীনের রাজত্বকাল (৬৩২-৬৬১ সাল) শেষ হয়। শেষ দুই জন খলিফা, মোহাম্মদ (সাঃ) এর দুই জামাতা হযরত উসমান (রাঃ) (৬৪৪-৬৫৬) ও হযরত আলী (রাঃ) (৬৫৬-৬৬১)- উভয়ই খিলাফতের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার রাজনীতির শিকার হয়ে শহিদ হন।

হযরত আলী (রাঃ) এর শাসনামলে ইসলামি খিলাফতে গৃহযুদ্ধ লেগেছিল। এ সময়কাল ইসলামে ১ম ফিতনা বা গৃহযুদ্ধ (৬৫৬-৬৬১) নামে পরিচিত। বিবদমান দু’পক্ষের একদিকে ছিল মোহাম্মদ (সাঃ) এর জামাতা হযরত আলী (রাঃ) আর অন্যপক্ষে ছিল হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)। হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) আবু সুফিয়ান (রাঃ) এর পুত্র এবং মোহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী উম্মে হাবিবা (রাঃ) এর সৎভাই; অর্থাৎ, মোহাম্মদ (সাঃ) এর শ্যালক।

১ম ফিতরার দুটি বিখ্যাত যুদ্ধের দ্বিতীয়টি সিফিনের যুদ্ধ। ৬৫৭ সালে এ যুদ্ধ হয়। প্রথমটি তার আগের বছরের উষ্ট্রের যুদ্ধ। হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর মধ্যে সিরিয়াতে সিফিনের যুদ্ধ হয়েছিল। উভয় পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে এ যুদ্ধ শেষ করে।

হযরত আলী (রাঃ) এর হত্যার পরে তাঁর বড় ছেলে হাসান (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্বে আসেন। তবে ছয় বা সাত মাসের বেশি শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেননি। হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। এ ফিতনা শেষ হয় বিখ্যাত এক চুক্তির মাধ্যমে। নাম ‘হাসান-মুয়াবিয়া চুক্তি’ (৫৬১)।  

এ চুক্তির ফলে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) খিলাফতের ক্ষমতায় আসলেন। উমাইয়া শাসনের সূত্রপাত হলো। তবে শর্ত  থাকে যে, হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) রাজবংশ চালু করবেন না; অর্থাৎ তাঁর পরে তাঁর সন্তানেরা ক্ষমতায় বসবে না। হযরত হাসান (রাঃ), হযরত হুসাইন (রাঃ) বা সার্বিক মতামতের ভিত্তিতে অন্য কেউ মুসলিম খিলাফতের দায়িত্বের জন্য নির্বাচিত হবেন। কেউ কথা রাখে না, হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)ও রাখেননি। কারবালার যুদ্ধ তারই একটি ফল। সেটার বিষয়ে আরেকদিন লিখবো। যা হোক, ৬৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।

মুয়াবিয়া (রাঃ) এর মনে ভিন্ন বাসনা ছিল। তিনি শর্ত ভেঙে তাঁর পুত্র ইয়াজিদকে ইসলামি খিলাফাতের শাসনকর্তা বানাতে চেয়েছিলেন। তাই হাসান (রাঃ) এর মৃত্যুতে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক লাভ ছিল। এ হতেই তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার যড়যন্ত্রের মূল ধারণা গৃহীত হয়েছে।

এ রকম একটা প্রতিবেদনও পাওয়া যায়। ৬৬৯ সালে মুয়াবিয়া (রাঃ) সে সময়ের বাইজানটাইনের সম্রাট ৪র্থ কনস্ট্যান্টাইনকে কাছে বিষাক্ত পানীয় পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন এর তিনি তা পাঠিয়েছিলেন (তথ্যসূত্র- Al-Majlisi MB. Bihar al-Anwar, Volume 44, Chapter 22. 1st ed. Beirut: Al-Wafaa’ Foundation [in Arabic], 1983.)।  তারপরেও এ ধারণাকেও সম্পূর্ণ ঠিক বললে সত্যতার ঝুঁকি থেকে যায়।

এর কারণ হলো, হাসান (রাঃ) এর সাথে আরও একজন দাসীকেও একই বিষ দেয়া হয়েছিল। তবে সেই নারী সময়মত বমি করে তা বের করে দিতে পেরেছিলেন বলে রক্ষা পেয়ে যান। এ ঘটনা আরেকটি সন্দেহের সুযোগ করে দেয়। ‘হযরত হাসান (রাঃ) বহু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ পুরুষ ছিলেন। বহু মহিলা স্ত্রী হিসেবে তাঁর গৃহে এসেছেন’। তাই নারী হিংসাবশতঃ (harem jealousy) বিষদানের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এ বার প্রশ্ন হলো, কে হাসান (রাঃ) কে বিষ দিয়েছিলেন। এখানেও রহস্য রয়েছে। হাসান (রাঃ) যখন বুঝতে পেরেছিলেন তাকে বিষ দেয়া হয়েছে, তিনি তখন হয়তো অনুমানও করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাকেও বহু বিষ পান করানো হয়েছে কিন্তু এবারের বিষ পান করানো ছিল সবচেয়ে কঠিন’। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘বিষক্রিয়ায় তাঁর কলিজা ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল’। তাঁর চিকিৎসক বলেন, ‘বিষে তাঁর নাড়ি-ভুঁড়ি কেটে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছে’।

একাধিক সূত্র মতে, হাসান (রাঃ) কে একাধিকবার বিষ দেয়া হয়েছিল। আনুমানিক ৪০ দিনের মধ্যে তাঁকে ৩ বা ৪ বার বিষ খাওয়ানো হয়েছিল। খেদমতগার না হলে এতবার বিষ দেয়া অসম্ভব। তবে হুসাইন (রাঃ) এর বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি কারো নাম উল্লেখ করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যাকে সন্দেহ করি সে-ই যদি প্রকৃত শত্রু হয়ে থাকে, বিষ পান করিয়ে থাকে তাহলে আল্লাহই তো তার কঠির শাস্তির ব্যবস্থা করবেন’।

বিষ দেওয়ার সন্দেহের তীর বার বার যার দিকে পৌঁছেছে, তিনি হলেন তাঁর স্ত্রী জায়েদা (জা’দা)। কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন যে, মুয়াবিয়া (রাঃ) এর পুত্র ইয়াজিদ জায়েদার নিকট সংবাদ পাঠান যে, সে যদি হাসান (রাঃ) কে বিষপান করাতে পারে তবে ইয়াজিদ তাকে বিয়ে করবে। মৃত্যুর পরে পূর্ব প্রস্তাব মতে তাকে বিয়ে করার জন্য  সংবাদ পাঠায়। উত্তরে ইয়াজিদ বিবাহে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, ‘আল্লাহর কসম! তুমি হাসানের স্ত্রী হিসেবে ঘর সংসার কর তা আমরা চাই নি, এখন কি তুমি আমার স্ত্রী হও তা আমি চাইব?’

এখানেও একটি কথা মনে রাখতে হবে। আত্মীয়তার সম্পর্কে মুয়াবিয়া (রাঃ) হাসান (রাঃ) এর নানা। সেই সূত্রে ইয়াজিদ সম্পর্কে জায়েদার মামা-শ্বশুর। অবশ্য প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কাছে সম্পর্ক মূল্যহীন।

এবার শেষ প্রশ্ন-কি ছিল সেই বিষ। কোনো একজনের বয়ানে শুনলাম এটা নাকি হীরার গুঁড়ো ছিলো। তিনি সুরে সুরে সে সব বয়ান করেছেন। এ কথা শুনেই আমার এ বিষয়ের গভীরে জানার ইচ্ছে হয়েছে। ভালই হয়েছে। জানা হলো।

সে কালে ময়নাতদন্তের কোনো সুযোগ ছিলো না। তাই নিশ্চিত করে বলা যাবে না কি ছিলো সেই বিষ। তাই বিষের ক্রিয়া ও বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত উপসর্গ বিশ্লেষণ করেই গবেষকরা বের করেছেন বিষটা আসলে কি ছিল। লেখার শুরুর দিকে আমি সেই গবেষণার প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছি।

গবেষকরা মনে করেন, পানিজাতীয় কোন দ্রব্যে মিশিয়ে এ বিষ দেয়া হয়েছিল। ইসলামে হারাম বিধায় তিনি মদ পান করতেন না। দ্রবণের সুবিধার্থে দুধ বা ঘোল (yogurt) জাতীয় পানীয় ব্যবহৃত হতে পারে। তিনটি বিষয়ের উপরে বিষ সম্পর্কে ধারণা করা হয়েছে। এক) সোনালি রঙের পানীয় (gold filings); দুই) চামড়ায় সবুজাভাব (green coloring of skin); এবং তিন)  রক্তবমি। এ সব উপসর্গের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা (সমীকরণসহ) ঐ গবেষণা পত্রে দেয়া আছে।  

উক্ত উপসর্গের প্রেক্ষিতে গবেষকরা মনে করছেন যে, হাসান (রাঃ) কে মারকারি (১) ক্লোরাইড (mercury(I) chloride, Hg2Cl2) পান করানো হয়েছিল। এটি ক্যালোমেল (calomel) নামেও পরিচিত।  এই হলো সেই ঘটনা।  সত্য জানার চেষ্টা থাকলে সত্য জানা এ যুগে কোনো কঠিন কাজ নয়। সময় বদলেছে, আমাদেরকেও বদলাতে হবে। সুরে সুরে বয়ান করলেই মানুষ এখন তা সহজে গ্রহণ করে না। তারা জানতে শিখেছে, বুঝতেও শিখে যাবে।