গন্তব্যহীন চিঠি

 “পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। … … …ওর মধ্যে আরও একটা রস আছে … … …যাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখির অবসর ঘটেনি তারা পরস্পরকে অসম্পূর্ণ করেই জানে… . লেফাফাটি চিঠির প্রধান অঙ্গ। ওটা একটা মস্ত আবিস্কার।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

প্রিয় বন্ধু ও নিমাইয়ের মেমসাহেব,

কেমন আছো? কিছু জানার ছিল, জানা হয়নি। তাই তোমাকে লিখছি। আমাদের গ্রামে কি সুকান্তের সেই রানার এখনও আসে? তারা শঙ্করের ডাক হরকরা, রবীন্দ্রনাথের পোস্ট মাস্টার? নাকি রানারের ঝুম ঝুম শব্দ মুছে কেবলই কুরিয়ারের সার্ভিসের মোটর সাইকেলের ভটভট শব্দ! প্রাণের বন্ধু, তোমার তো মনে আছে, আমরা স্কুলে পত্র লেখা শিখেছিলাম- টাকা চেয়ে পিতার কাছে পুত্রের চিঠি, ধূমপানের কুফল বর্ণনা করে ছোট ভাইয়ের কাছে চিঠি, বনভোজনের বর্ণনা দিয়ে বন্ধুকে লেখা চিঠি। কতবার বাংলা স্যার আমাদের সেসব চিঠিতে ভুল ধরে দিতেন। আমরা কি সেদিন জানতাম রে, এসব চিঠি একদিন আর কোন কাজে আসবে না? তুমি কি কোন চিঠিতে আজও লেখো, “শ্রীচরণকমলেষু”? না, তাও আজ মৌলভী মশাইয়ের ভয়ে … … …।

তোমার তো সাহিত্যে বেশ নাম ছিল। বলতে পারবে মতিহারকে লেখা চিঠিতে ফজিলাতুন্নেসাকে দুফোটা অশ্রু বিসর্জনের যে অনুরোধ নজরুল করেছিল তার কি কোন উত্তর এসেছিল? অথবা, লাঙ্গলের ফলা হয়ে, ধূমকেতুর পুচ্ছ হয়ে যে নার্গিস আরা খানম তাঁর হৃদয়ে পদচিহ্ন একেঁছিল, সেও কি কোন উত্তর………। আমার আর এসব জানা হয়নি। আরোও একটা কথা, জানো তো মেজ বৌ মৃণাল পতিদেবতার ২৭ নম্বরের মাখন বড়ালের গলি যে দিন ছেড়েছিল, সেদিন রবীন্দ্রনাথকে সে একটি প্রশ্ন করেছিল, “জগতের মধ্যে যা কিছু সবচেয়ে তুচ্ছ, তাই সবচেয়ে কঠিন কেন?” – এই নারী কি কোন জবাব পেয়েছিল তার কাছ থেকে? একটু জানাবে আমায়?

জানতে পারিনি মহাদেব সাহাকে কিভাবে তার প্রিয়তমা মিথ্যা করে হলেও লিখেছিল, ভালবাসি। আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখার জন্য যে অনুরোধ করেছিল অভিমানী রুদ্র, সকাল হয়ে তার একটি উত্তর অবশ্য দিয়েছিল তসলিমা। বলেছিল শিমুল, নেলিখালা আর লালবাগের সেই বাড়িটির কথা। কিন্তু বাবার কাছে লেখা নাসরিনের সেই প্রশ্ন “দেশ কি এভাবেই এরকম ভুতুরে অন্ধকারে ডুবে থাকবে?” কিংবা, মায়ের কাছে তাঁর সেই প্রশ্ন “তুমি কি মানুষ ছিলে?” ও কি এসবের কোন উত্তর পেয়েছে? নাকি এদেশ থেকে ওপারে ধর্মদ্রোহিতাদের কোন চিঠির উত্তর দেয়া হয়না! তোমার কি মনে আছে এসব চিঠির কথা, নাকি সব ভুলে গেছিস টেক্স মেসেজের টুং টাং আওয়াজে? কুরচিকে বুদ্ধদের লিখেছিল, “যার বিবেক বেঁচে থাকে তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার বড় উপায় বিবেকহীন হওয়া।” কুরচিরাকি আজ সুখি রে? তুমিও কি? নাকি কেবলই লতিফুলের প্রিয় আকাশীরা? জানি, সবাই সুতপার মতো মানবী এক গাছ। ওদের মুক্তি নেই, মুক্তির নেশামাখা চিঠির কোন উত্তর নেই। চিঠিই তো নেই, তাই না?

দুটো জেনারেশনের যে দ্বন্দ্বের কথা রুদ্র তার বাবাকে লিখেছিল তা কি আজও আছে? আমাদের গ্রামে ছেলেরা বাবার কাঁধে করে এখনও ঈদের জামাতে, শনি-মঙ্গলবারের হাঁটে, বা ষাড়ের লড়াই দেখতে যায়? কতদিন এসব দেখিনা .. .. এখনও হয়? .. . . হয়তো আর কোনদিনও এসব দেখা হবে না। জেলখানার চিঠিতে নাজিম ঠিকই বলেছিল “বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়ঝোড় এক বছর।” হুম. . . . আমাদের তো অনেক বছরই হয়ে গেলো।

রাতাজাগা হাতের কাঁপনে, মিহি আঙ্গুলের বুনোটে গড়া আঁকাবাঁকা অক্ষরের ভালোবাসামাখা সেসব চিঠি। হাজারবার পড়া প্রেমের সেই চিঠিগুলি। ছোট ভাই, বোন কিংবা বান্ধবী বা বন্ধুর হাতে আসার অপেক্ষার সেই চিঠি। বালিশের কাভারের ভেতরে, জাজিমের তলায়, মাচাঁর উপরে, মানিব্যাগে, ট্রাংকে, বইয়ের ভিতরে রাখা সেসব চিঠি আরা গোলাপের শুকনো পাপঁড়ি। সেদিনের আমরা আর আজকের এদের মাঝে জেনারেশনের গ্যাপ বুঝি এখন অনেক হয়ে গেছে। আচ্ছা, টেক্স মেসেজে কি প্রেমের এই অনুভূতি কি ঠিক সেভাবেই আজ অনুরিত হয়?

গ্রীন রোডের ডাক্তারের চেম্বারে আজও শুনতো পাই সেই আত্ম চিৎকার। একটি জীবনের মরণ কান্না। তুমিও কি শুনতে পাও? না শুনলেই ভালো। স্মৃতি যন্ত্রণার বলে আমরা ভুলে যাই, ভুলে যাই বলেই আমরা মানুষ, মানুষ বলেই মনে না রাখার জন্য আমাদের কোন অনুতাপ নেই। মানুষ হতে আর পারলাম কোথায়! কেবলই মানুষের ছায়া হয়েই রয়ে গেলাম।

উত্তর দিও। না চিঠি দিতে বলসি না, ওটাতো এখন প্রাক্তন রাশিয়ার ক্রিমিয়া। পুরোনো পথে ফিরতে চাইলেও পারছে কোথায়? জানো তো, আমি মহিলা কলেজের সেই ঠিকানায় আজ আর নেই। কেবলই আকাশের ঠিকানায় আছি, তবে রুদ্রের মতো সীমাহীনে নয়, সীমান্তে। আগের ঠিকানায়।

প্রথম প্রকাশ- ২৩ মে ২০১৫

সম্পর্কিত অন্যান্য ব্লগ