চিত্রশিল্পে সাতার ও নিমফ

Nymphomaniac বা পুরুষাক্ত নারী

ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের আইডি হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে বাংলা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো- “পরী”। ফেসবুক ঘাটলে সব রঙের পরী (যেমন- ‘লাল পরী’, ‘নীল পরী, ‘সাদা পরী’ …..), সব স্থানের পরী (যেমন- ‘জলপরী’, ‘স্বপ্নপরী’, ‘বনপরী’…..) পাওয়া যায়।

“পরী” শব্দটি কেন আইডি হিসেবে এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে তা একটি রহস্য থাকতে পারে। ‘পরী’ শব্দটির ইংরেজি হলো ‘নিমফ’ (nymph)। গ্রিক, রোমান ও হিন্দু পুরাণে (উর্বশী, রম্ভা, আলসেইডস ইত্যাদি) নিমফের পরিচয় পাওয়া যায়। পুরাণগুলোতে এ পরীরা মূলত দেবতাদের শয্যা সঙ্গিনী হিসেবে বেশি খ্যাত ছিলো।

পরবর্তীকালে মনোবিজ্ঞানে নিমফ নিয়ে একটি মানসিক রোগের নামকরণ করা হয়। রোগটির নাম ‘নিমফোম্যানিয়া’ (Nymphomania)। পুরুষদের প্রতি নারীদের অপ্রতিরোধ্য যৌনাকাঙ্ক্ষা বোঝাতে নিমফোম্যানিয়া ব্যবহৃত হয়; অর্থাৎ, যে নারী পুরুষের প্রতি অসম্ভব যৌনাকাঙ্ক্ষা অনুভব করে তাকে নিমফোম্যানিয়াক (Nymphomaniac) বলে।

“পরী” নামধারী সকল ফেসবুক আইডিধারীরা এ রোগে আক্রান্ত কি না তা অবশ্য নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। তবে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

চিত্রশিল্পে সাতার ও নিমফ
চিত্রশিল্পে সাতার ও নিমফ

Satyromaniac বা কামাসক্ত পুরুষ

নিমফোম্যানিয়ার পুরুষবাচক শব্দ রয়েছে। তা হলো সাতারোম্যানিয়া (Satyromania)। এমন কিছু পুরুষ আছে নারী দেখলে যাদের মাথা ঠিক থাকে না। এদের কাছে নারী মানেই শয্যাসঙ্গিনী, ভোগ্যপণ্য। এ ধরণের পুরুষকে সাতারোম্যানিয়াক (Satyromaniac) বলে।

গ্রিক পুরাণে সাতার (Satyr) একটি সংকর প্রাণি। এদের দেহ ছিলো পুরুষের এবং কান, পা ও লেজ ছিলো ঘোড়ার মতো। রোমান পুরাণের সাতারের আবার ছাগলের মতো শিংও ছিলো। তবে উভয় পুরাণে সাতার ছিলো অত্যন্ত কামুক জাতীয় প্রাণি। সাতার (Satyr) শব্দটির বাংলা অর্থ ‘বনদেবতা’।

ফেসবুকে ‘বনদেবতা’ নামে খুব বেশি আইডি পাওয়া যায় না। সমাজে অবশ্য সাতারের মতো কোনো প্রাণি দেখা যায় না; কিন্তু এ চরিত্রের মানুষের অভাব নেই।

Narcissist বা স্বকামী

নিজের রূপে বা গুণে মুগ্ধ থাকাকে বলে নারসিসিজাম। এক কথায়, আত্মপ্রেমেনিমগ্নতা। মনোবিজ্ঞানে এ প্রবণতাকে মানসিক অসুস্থতার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গ্রিক পুরাণে নার্সিয়াস (Narcissus) নামে অত্যন্ত সুদর্শন এক তরুণ ছিল। লেকের পানিতে একদিন সে তাঁর নিজের চেহারা দেখে নিজের প্রেমে পড়ে। সে পানিতে ছবির মানুষটিকে পাবার জন্য লেকের পাড়েই আমৃত্যু পড়েছিল। নার্সিয়াসের নিজেই নিজের প্রেমে পড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নার্সিসিজাম শব্দের উৎপত্তি হয়।

গ্রীক পুরাণের নদী দেবতা সিফিসাস এবং জলপরী লিরিউপির পুত্র নার্সিসাস ৷ অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী নার্সিসাসের রূপের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না ৷ আর এই রূপ মাধূর্যই তাকে অহংকারী আর আত্মগর্বিত যুবকে পরিণত করে ৷ যেকোন মেয়ে এমনি পরীরাও তাকে দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে যেত ৷

ছোটবেলা থেকেই নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে অদ্ভূত অহংকার জাগে নার্সিসাসের মনে ৷ সে শুধু পুরুষ নয়, নারীদেরকেও তার তুলনায় রূপে নিকৃষ্ট ভাবা শুরু করে ৷ কারও ভালোবাসায় সাড়া দিতেন না। তিনি মনে করতেন তার যোগ্য ও সমকক্ষ কেউ নেই।

Echo বা প্রতিধ্বনি

একো ছিলেন অপূর্ব মিষ্টি কন্ঠস্বরের অধিকারী এর অপ্সরা। গ্রিক মিথলজিতে নার্সিসাসের নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই একো ৷ অন্যের কথার প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া একো নিজে কোন কথা বলতে পারতো না ৷ সে নার্সিসাসের প্রেমে পড়েছিলো ৷

নার্সিসাস বনে যেত শিকার করার জন্য আর বনপরী ইকোও তাঁর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকতো ৷ সে নার্সিসাসের পেছনে পেছনে ঘুরতো। কিন্তু কোন কথা বলতে পারতো না। একদিন সে সুযোগ পেয়ে গেল ৷ নার্সিসাস তার সঙ্গীদের ডাকছিল “কেউ এখানে আছে?” একো আনন্দিত স্বরে শেষ শব্দটি প্রতিধ্বনি করল, “আছে, আছে ৷” গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইকোকে নার্সিসাস ডাকলো “এসো”৷ ইকো আবারও উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিল “এসো” ৷

দুই বাহু বাড়িয়ে একো বেরিয়ে এলো বন থেকে। কিন্তু অহংকারী নার্সিসাস বিরক্তিতে তার মুখ ফিরিয়ে নিলো ৷ সে বললো, ‘’আমি বরং মারা যাবো কিন্তু তোমাকে কাছে আসতে দেব না ৷” একো তার লজ্জা লুকানোর জন্য প্রবেশ করলো এর নির্জন গুহায় ৷ ধীরে ধীরে বেদনা আর কাতরতায় তার শরীরও লীন হয়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তার কন্ঠস্বর, যা অন্যের উচ্চারিত শব্দকে শুধু অনুকরণ করতো। নার্সিসাসের এ ধরনের আচরণের জন্য প্রতিশোধের দেবী নেমেসিস তাকে অভিশাপ দিয়েছিলো।

হরিণ শিকার করার পর ক্লান্ত নার্সিসাস একদিন পানির আশায় একটি হ্রদের পাড়ে আসলো। নার্সিসাস যখন পানির জন্য নিচু হলো তখনি প্রথমবারের মত নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পেল। পানিতে প্রতিফলিত নিজের রূপ দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে সে বার বার বলতে লাগলেন, “এত সুন্দর! এত সুন্দর!” নিজের প্রতিফলনকে ছুঁয়ে দেখার জন্য সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং পানিতে ডুবে মারা গেল ।

চিত্রশিল্পে নার্সিসাস ও একো
চিত্রশিল্পে নার্সিসাস ও একো

Draconian বা অত্যন্ত কঠোর, কঠিন

ড্রাকোনিয়ান শব্দটি মূলত নিয়ম, আইন বা বিধি-বিধানের সাথে বেশি ব্যবহৃত হয়। যে কোন শক্ত, কঠোর আইন-কানুনকে ড্রাকোনিয়ান (Draconian) আইন বলে।

খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকে ড্রাকো নামে গ্রিসে এক আইন প্রণেতা সিনেটর ছিলো। তিনি গ্রিসের বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংকলন করেন। তার এ সংকলন ছিলো গ্রিসের সংবিধান।

সিনেটর ড্রাকোর আইনগুলো বরাবরই খুব কঠিন ছিল। তার আইনে খুব সামান্যতম অপরাধেও ফাঁসীর মতো গুরুদণ্ড প্রদানের বিধান ছিলো। এই জন্য বর্তমান সময়ের যে কোন কঠোর, কঠিন, অবশ্যপালনীয় আইন/বিধানকে ড্রাকোনিয়ান আইন বলে।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, ড্রাকুলা (Dracula) শব্দটির সাথে সিনেটর ড্রাকোর অর্থ ও রূপগত বেশ মিল থাকলেও দুটি শব্দ ভিন্ন। এদের বুৎপত্তিও ভিন্ন।

(ধারাবাহিকভাবে শব্দরহস্যভেদ চলবে)