ধর্ম কীভাবে টিকে থাকে

ধর্ম প্রাচীনতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সম্প্রদায়, উপ-সম্প্রদায় ইত্যাদি মিলিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় ৪২০০ ধর্মের আগমন ঘটেছে। বর্তমানে মাত্র শ’খানেক ধর্ম বিশ্বাস টিকে আছে। বাকী সবই কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। তার মানে কি ধর্ম হারিয়ে যাচ্ছে?

আমার উত্তর ‘না’। যাচ্ছে না।

ধর্ম বিশ্বাস সভ্যতার শুরুতে যেমন ছিল, আজও তেমনি আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। সময়ের পরিবর্তনে বিজ্ঞানের যতই উৎকর্ষতা বাড়ুক না কেন, ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের যতই বিভেদ তৈরি হোক না কেন, ধর্ম তার নিজস্ব ক্ষমতার স্থানে ছিল, আজো আছে।

কিন্তু কীভাবে ধর্ম টিকে আছে?

এ উত্তরে জন্য পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস জানা খুবই প্রয়োজন।

আমরা যদি ১০০-১৫০ বছর আগের পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর (সে সময়ে এগুলো রাজ্য, সাম্রাজ্য এসব নামে ছিল) কাঠামো দেখি তবে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ।

বিংশ শতকের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রগুলো একনায়কতান্ত্রিক ছিল। এক রাজা রাজ্য চালাতেন। রাজার বংশধরেরা বংশানুক্রমে রাজা হতো, নতুবা অন্য কেউ দখল করে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতো। এ সব রাজাদের অধীনস্ত রাজ্যের লোকেরা যে ধর্ম পালন করতো, তারা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে সে ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করতো। যদি এমন হতো যে, ঐ এলাকার লোকজন একাধিক ধর্ম পালন করে, তবে সেখানে ধর্মযুদ্ধ হতো।

তিনটি কারণে ধর্মযুদ্ধের ঝুঁকি ছিল- (১) রাজা যদি গরিষ্ঠ লোকের ধর্মের হতো, তবে সে বাকীদেরকে নিজের ধর্মে টানার চেষ্টা করতো। এক্ষেত্রে রাজা উদারপন্থী হলে ধর্মযুদ্ধের সম্ভাবনা কম ছিলো। (২) যদি সে সংখ্যালঘু ধর্মের লোক হতো, তবে ধর্মযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল হতো। এক্ষেত্রে রাজা উদারপন্থী হলে রাজ্য হারানোর সম্ভাবনা থাকতো। (৩) রাজার রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো ধর্ম না থাকলে, রাজা নিজে একটা ধর্ম চালু করে দিতো আর সবাইকে ঘাড় ধরে সেটা পালন করাতো।

কিন্তু কেন? রাজাদের রাজ্যক্ষমতার জন্য ধর্মের প্রয়োজন কেন?

রাজাদের রাজ্য ক্ষমতার জন্য বাইরের শত্রু সামলানোর জন্য যেমন সামরিক বাহিনী দরকার, ঘরের শত্রু সামালাতে তেমনি ধর্ম প্রয়োজন। বিশেষ করে, সেই সব রাজারা যারা বংশানুক্রমে রাজ্য শাসন করে, যাদের রাজ্য পরিষদে সাধারণ মানুষের কোনো স্থান নেই, তাদের রাজ্যের ভেতরে স্বৈরশাসন কায়েম করার জন্য ধর্মের কোনো বিকল্প নেই। এরা ধর্ম দিয়ে শাসন করে। বিশ্বাস দিয়ে শোষণ করে। ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান দিয়ে সাধারণ জনগণের মন যুগিয়ে চলে। এ জন্য রাজাদের অনেকে নিজেরা ধর্ম চালু করেছিল, অনেকে বিভিন্ন ধর্মের ধারক-বাহক সেজেছিল।

রাজাদের বংশানুক্রমিক শাসন টিকে রাখার জন্য, সাধারণ মানুষকে একসাথে বেঁধে রাখার জন্য ধর্মের কোনো বিকল্প আজো তৈরি হয়নি। তাই ধর্ম টিকে ছিল, টিকে আছে, থাকবে।

তবে ধর্মেরও খারাপ সময় এসেছে। রাজারা যখন ধর্মের অত্যাচারে সাধারণ মানুষকে অতিষ্ট করেছে, তখন তারা ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বিজ্ঞান দিয়ে করেছে, দর্শন দিয়ে করেছে। তবে তাতে ধর্মের খুব একটা ক্ষতি হয়নি।

রাষ্ট্র বরাবরই ধর্মকে সহায়তা করেছে, বিজ্ঞান বা দর্শনকে নয়। কারণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞান, দর্শনের চেয়ে ধর্ম বেশি কার্যকর। সাধারণ জনগণের বেশি অশিক্ষিত হয় আর অশিক্ষিতের কাছে ধর্মের জ্ঞানের চেয়ে বড়ো কোনো জ্ঞান থাকতে পারে না।

বিজ্ঞান বা দর্শন ধর্মকে কাবু করতে না পারলেও, ধর্মকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে গণতন্ত্র। তবে সরাসরি এ কথা বললে একটু ভুল হবে। একটি পেঁচিয়ে বলতে হবে। গণতন্ত্র একনায়কের শাসনকে ধ্বংস করেছে। সব ধর্মের সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষকে রাষ্ট্র শাসনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে এককভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করার সুযোগ হারিয়েছে। এই সুযোগে নাস্তিকতাবাদও প্রসার লাভ করেছে।

এ জন্য বর্তমান বিশ্বে যে রাষ্ট্র কাঠামো যত বেশি গণতান্ত্রিক সে রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব তত কম, নাস্তিক্যবাদের প্রভাবও তত বেশি। বিশেষ করে, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো দেখলে এখন তা যথেষ্ট বোঝা যায়। তবে আফ্রিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ প্রভাব এখনও ততটা স্পষ্ট নয়।

এর মূল কারণ সাধারণ জনগণের শিক্ষায় যথেষ্ট অনগ্রসরতা। গণতন্ত্রের সুফল পেতে হলে সাধারণ জনগণের শিক্ষামান উন্নত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। জনগণের যথেষ্ট উন্নতমানের শিক্ষা না থাকলে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রকে নেতৃত্বদানের যোগ্যতা তৈরি হয় না। ফলে গণতন্ত্র থাকা বা না থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।

মধ্যপ্রাচ্যে এখনও গণতন্ত্র আসেনি। আফ্রিকা বা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র না বলে ধণিকতন্ত্র বলা উচিত। অতীতের নিয়মে সেখানে রাষ্ট্র ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় প্রভাব এখনো এতটা প্রবল কেন?

প্রথম কারণটা ইতোমধ্যে বলেছি, সাধারণ জনগণের উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থার অভাব। দ্বিতীয় কারণ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। ঐ দুই অঞ্চলের দেশগুলোর রাজনীতিতে প্রভাবশালী ধর্মীয় রাজনৈতিক দল আছে। তৃতীয়ত, বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

কোনো দেশে যখন ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ধর্মীয় রাজনৈতিক দল যখন থাকবে, তখন তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকুক বা না থাকুক, রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হতে পারবে না। গণতন্ত্র থাকুক আর ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকুক, রাষ্ট্র ধর্মের তাবেদারী করতে বাধ্য থাকবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার রাজনীতি ধরে রাখতে হলে রাষ্ট্রকে ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেই হবে। এটাই বাস্তবতা।

তাই সভ্যতার আদিতে ধর্ম ছিল। সভ্যতার বিকাশে ধর্ম ছিল। সভ্যতার উৎকর্ষে ধর্ম আছে। সভ্যতার বিলুপ্তিতেও ধর্ম থাকবে।