সক্রেটিসের জীবনের শেষ কয়েকটা ঘণ্টা ও তাঁর শেষ সময়ের ভাবনা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। সক্রেটিস নিজে কোন বই লেখেননি। তাই প্লেটোর “ডায়লোগস” ভরসা। তিনি কাব্যের চেয়েও মনোরম গদ্যে সে কাহিনী বর্ণনা করেছেন। এটা থেকে সেই ক্ষণের বিবরণ পাওয়া যায়।
সক্রেটিস দর্শনের প্রথম শহীদ। স্বাধীন চিন্তার প্রয়োজন ও অধিকার প্রকাশের জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রবিরোধী ছিলেন। সাধারণ জনতা রাষ্ট্র চলাবে সেটা তিনি বিশ্বাস করেননি। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রনায়ককে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হতে হবে। কেবল সাধারণ জনগণ থেকে নির্বাচিত হলে হবে না।
ক্ষুদ্ধ জনতা তাঁর মৃত্যু-দন্ডেরই রায় দিলেন। তাঁকে হেমলক নামক বিষ পান করতে হবে। জনতার রায়ে যখন তাঁর মৃত্যু নির্ধারিত হলো, তিনি ক্ষমা চাইতে পারতেন। হয়তো তাকে ক্ষমাও করা হতো। কিন্তু সক্রেটিস তা করেননি।
তাঁর বন্ধুরা জেলে এসে তাঁকে সহজে পালানোর সুযোগ করে দিলেন। জেল আর স্বাধীনতার পথে যেসব কর্মচারী আর কারা-রক্ষকরা বাধাস্বরূপ ছিলো, তাঁর বন্ধুরা তাদের সবাইকে প্রচুর ঘুষ দিয়ে কাবু করে ফেলেন। কিন্তু সক্রেটিস রাজী হলেন না। তিনি এভাবে পালাবেন না। তিনি বন্ধুদের বললেন,
” তোমরা আনন্দ কর আর সবাইকে বল যে তোমরা শুধু আমার দেহটাকেই সমাধিস্থ করছ”। এ কয়টি কথা বলার পরে তিনি গোসলখানায় গিয়ে ঢুকলেন। অনেকক্ষণ কাটলো।
তখন প্রায় সূর্যাস্ত। সে বাইরে এসে আবার সবার মধ্যে আসন গ্রহণ করলেন। কিন্তু বিশেষ কিছু বল্লেন না। তখুনি কারা-অধ্যক্ষ ঢুকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বললো:
”এ কারাগারে যারাই এসেছে তাদের মধ্যে, হে সক্রেটিস, তোমাকে আমি সবচেয়ে মহৎ আর সবচেয়ে ভদ্র বলেই জানি। সরকারী হুকুম তামিল করতে গিয়ে আমি যখন অন্য দন্ডিতদের বিষ-পানের নির্দেশ দিই, তখন তারা রেগে আমাকে অভিশাপ দেয়, তুমিও সেরকম করবে তা আমি মনে করি না। আমি জানি তুমি আমার উপর রাগ করবে না-কারণ, তুমি জানো, আমি এর জন্য দায়ী নই। বিদায় শুভ হোক। এটা অনিবার্য।”
সক্রেটিস তার দিকে তাকিয়ে বল্লেন, ”আমিও তোমার শুভ কামনা করি-তুমি যা বলেছ সে মতই কাজ করবো”।
কারা-অধ্যক্ষ অশ্রুপ্লাবিত চোখে সে ফিরে গেলো। এরপর অন্যদের দিকে ফিরে সক্রেটিস বল্লেন:
”কি চমৎকার মানুষ! জেলে আসার পর থেকে লোকটি আমাকে প্রায় দেখতে আসতো আর এখন দেখো তার কি গভীর শোক আমার জন্য। ওর কতা মতোই আমি কাজ করব। বিষ-পাত্র যদি তৈরি থাকে, নিয়ে আসতে বলো; আর তৈরি না হলে পরিচালককে তৈরি করতে বলো।”
সক্রেটিসের এক শিষ্য ক্রিটো তাঁকে বল্লেন: ”এখনো পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য দেখা যাচ্ছে। দন্ডিতদের অনেকে এর অনেক পরেও বিষ পান করে। দন্ড ঘোষিত হওয়ার পর কেউ কেউ খানাপিনা করে ফুর্তিতে মত্ত হয়ে ওঠে। কাজেই তাড়াহুড়া করার কিছুই নেই। এখনো সময় আছে।”
সক্রেটিস বল্লেন: ”ক্রিটো, তুমি যাদের কথা বল্লে তারা ঠিকই করে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, এটা করলে তারা মৃত্যুর পরে লাভবান হয়। কিন্তু আমি বিলম্বে বিষপান করলে আমার কোন ফায়দা হবে না। যে জীবন ইতিমধ্যে নিঃশোষিত তাকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ কি? সে তো শুধু নিজেকে নিজের কাছে হাস্যকর করা।”
একথা শোনার পর ক্রিটো চাকরকে ইশারা করলেন। চাকরটা ভিতরে ঢুকলো। অল্পক্ষণ পরে কারা-রক্ষককে সঙ্গে নিয়ে বিষপাত্র হাতে সে ফিরে এলো। সক্রেটিস কারা-রক্ষককে বল্লেন: ”বন্ধু, তুমি এসব ব্যাপারে পারদর্শী। কিভাবে অগ্রসর হতে হবে আমাকে বলে দাও?”
লোকটি বল্লো, ” বিষপান করার পর তুমি শুধু ঘরময় পায়চারি করতে থাকবে। পা যখন ভারী হয়ে আসবে, তখন শুয়ে পড়বে। বিষের ক্রিয়া এবার শুরু হবে।”
এ সময় সে বিষপাত্রটি সক্রেটিসের হাতে দিলো। নির্ভয়ে, কিছুমাত্র বিবর্ণ না হয়ে, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত সহজ বিনয়ের সাথে সক্রেটিস পাত্রটি গ্রহণ করলেন এবং বল্লেন:
”কি বল? এ পাত্রের কিছু পানীয় দিয়ে কোন দেবতাকে অঞ্জলি দিলে কেমন হয়? করব, না কি করব না?” লোকটি উত্তরে বল্লে: ”সক্রেটিস, যতটুকু প্রয়োজন আমরা শুধু ততটুকু হেমলক করে থাকি।”
সক্রেটিস বল্লেন: ”বুঝতে পেরেছি। তবুও এ জগৎ থেকে অন্য জগতে আমার ভ্রমণটা যাতে সুখের ও শান্তির হয় সে জন্য দেবতাদের কাছে আমার প্রার্থনা করা উচিত এবং আমি তা করব। আমার এ প্রার্থনা, এ প্রার্থনাটুকু যেন কবুল হয়।” তারপর পান-পাত্রটি ঠোঁটে লাগিয়ে বিষটা সানন্দে পান করে ফেল্লেন।
কেউ কাঁদলে লাগলো। কেউ চিৎকার। শুধু সক্রেটিস রইলেন শান্ত নির্বিকার। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: ”কিসের জন্য এমন অদ্ভুত কান্না? আমি শুনেছি, পুরুষের শান্তির সঙ্গেই মৃত্যু বরণ করা উচিত। কাজেই শান্ত হও, ধৈর্য্য ধারণ করো।” তাঁর এ কথা শুনে সবাই লজ্জিত হলো এবং কান্না থামাল।
সক্রেটিস পায়চারি করতে লাগলেন। পরে বল্লেন তাঁর পা অচল হয়ে আসছে। নির্দেশ মতো এবার তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। যে লোকটি তাঁর হাতে বিষপাত্র দিয়েছিল, সে এবার সে বার বার তাঁর পায়ের দিকে তাকাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর লোকটি তাঁর পায়ের পাতায় জোরে চাপ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো তিনি কিছু অনুভব করতে পারছেন কিনা। তিনি বল্লেন, “না।”
তার পর তাঁর পা-ক্রমে ক্রমে উপরের দিকে চাপ দিয়ে আমাদের দেখালো যে তাঁর দেহ ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপর সক্রেটিস নিজেও হাত দিয়ে অনুভব করে বল্লেন; “বিষটা হৃদপিণ্ডে পৌছলেই সব শেষ হয়ে যাবে।”
সক্রেটিসের কোমরের দিক ঠান্ডা হয়ে এলো। মুখটা তিনি ঢেকে চাদরে ঢেকে রেখেছিলেন। আবরণ-মুক্ত করে বল্লেন, এটিই তাঁর শেষ কথা: ”ক্রিটো, এস্কেলেপিয়াস আমার কাছে একটি মোরগ পাবে, তুমি মনে করে আমার এ ঋণটা শোধ করবে ত?” তারপর আবার চাদরে মুখ ঢাকলেন। ক্রিটো বল্লেন: ”ঋণটা শোধ করা হবে। আর কিছু বলার আছে?”
এ প্রশ্নের আর কোন উত্তর মেলেনি। শুধু দু’এক মিনিটের মধ্যে একটা নড়ে ওঠার শব্দ শোনা গেল। পরিচালক তাঁর মুখ থেকে চাদর সরালো। তাঁর চক্ষু স্থির, অকম্পিত। মুখ হাঁ। ক্রিটো তাঁর চোখের পাতা আর মুখ বন্ধ করে দিলো।