ইতিহাস স্বাক্ষী, তেলের মূল্য রাশিয়া ওঠানামার সাথে রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) রাজনীতির একটি গভীর কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লকের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য হ্রাস পায়, অবিশ্বাস ঘণীভূত হয়, দূরত্ব বাড়তে থাকে-  এক কথায় ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ চলতে থাকে। ১৯৭৫ সালে ক্রমবর্ধমান এ সংকটকে একটি স্থিতাবস্থায় আনার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। ইতিহাসে এটি ‘হেলসিংকি চুক্তি’ (Helsinki Accords) নামে পরিচিত। এ চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে চেষ্টা করে।  তেলের দাম তখন ছিল ৫৫ মা.ড./ব্যা.।

১৯৭৯তে এসে সেই দাম বেড়ে ১০১ মা.ডলারে চলে আসে। সে সময়ে পশ্চিম সাইবেরিয়ার খনিগুলো থেকে রাশিয়ার তেল উত্তোলনও বেড়ে যায়। দ্রুত বর্ধনশীল তেল উত্তোলন ও তেলের চড়া দামে রাশিয়ার অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এই বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়ার তৎকালীণ সরকার প্রধান ব্রেজনেভ (সোভিয়েত উনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির সেন্টাল কমিটির মহাসচিব) আফগানিস্তান আক্রমণ করে।

এর সাত বছর পরে তেলের দাম ৩০ মা.ডলারে নেমে যায়। সে সময় মিখাইল গর্বাচেভ ‘পেরেসত্রইকা’ (পুনর্গঠন) ও ‘গ্লাসনস্ত’ (উন্মুক্ততা) প্রণয়ন করে। এক কথায়, ‘পেরেসত্রইকা’ ছিল পুঁজিবাদী জার্মানি, জাপান, আমেরিকার মডেলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বিকেন্দ্রীকরণের সংস্কারপন্থা। অন্যদিকে, ‘গ্লাসনস্ত’ ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষযয়ে খোলামেলা আলোচনার নীতি। এই দুই নীতির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক বেশী সহনশীল, গণতান্ত্রিক ও পাশ্চাত্যের বন্ধুপ্রতিম হয়ে ওঠে। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা- ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ১৯৯৮ সালের রুবল (রাশিয়ান মুদ্রা) সঙ্কট। ইয়েল্টসিনের সেই সময়কার রুবল সঙ্কটের মূলে ছিল তেলের দামের অস্বাভাবিক পতন। ব্যারেল প্রতি ২০ মা.ডলারেরও কম। ২০১৬ সালেও সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তেলের মূল্য রাশিয়া যখন ব্যারেল প্রতি ২৫ ডলারের কাছাকাছি তখন রাশিয়ান মুদ্রার মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। কয়েক বছর আগেও এক ডলারে ২৫-৩০ রুবল পাওয়া যেত, এখন পাওয়া যাচ্ছে ৮৫ রুবল।

২০০০ সালে পুতিন যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে আসে তখন ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ২৫ মা.ডলার। ক্ষমতাসীন হয়েই পুতিন আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। সে সময়ে রাশিয়ার কোনোরূপ ওজর-আপত্তি ছাড়াই ন্যাটো বাল্টিক দেশগুলোতে সম্প্রসারিত হয় এবং ওয়ান ইলেভেনের পরে ন্যাটোর সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আফগানিস্তান-ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনও বিনা বাধায় এগুতে থাকে।

আবারও সাত বছর। ২০০৮ সাল।তেলের মূল্য রাশিয়া ১০৫ মা.ড./ব্যা.। রাশিয়া জর্জিয়া দখল করলো। আমেরিকার সাথে রাশিয়ার সম্পর্কেরও অবনতি ঘটলো। এরপর ২০০৯ সালে বিশ্ব ব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, তেলের দাম হলো ৬৭ মা.ড./ব্যা.। এ সময়ে বারাক ওবামার প্রশাসন রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে “রিসেট” (reset) পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে একটি লাল বোতাম উপহার দেন যাতে রুশ ভাষায় লেখা ছিল “перегрузка”, যা বোঝাতে চেয়েছিল “পুনঃস্থাপন” (reset)। অবশ্য লাভরভের মতে, শব্দটির অর্থ “অতিরঞ্জন” (overcharge)। এ উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে ২০১০ সালে আমেরিকা, চিন ও রাশিয়া ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। রাশিয়ারও লাভ হয়েছিল, আমেরিকা রাশিয়ান সরকারি অস্ত্র রপ্তানিকারক এজেন্সির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ইরানের কাছে অস্ত্র রপ্তানির অভিযোগে এ সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল আমেরিকা।

তেলের মূল্য বনাম রাশিয়ার রাজনীতি