এটুকু বললে হয়তো বেশি বলা হবে না যে এক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট বাকী পৃথিবীর সকল রাজনীতির চেয়েও বেশী জটিল। দাবা খেলায় উভয় পক্ষই যেমন মধ্যমাঠের নিয়ন্ত্রণে ব্যতিব্যস্ত থাকে, আধুনিক সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ঠিক তেমনি ভাবে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যকে করতলে নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আজকের মধ্যপ্রাচ্য সংকট সূর্যোদয় হয়েছিলো শতাধিক বছর আগে ১৯১৬ সালের ১৬ মে যেদিন ‘সাইকস-পিকট চুক্তি’ (Sykes- Picot Agreement) কার্যকর হয়েছিল।

পৃথিবীতে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, শক্তিধর দেশগুলো দুই শিবিরে বিভক্ত- মিত্রশক্তি (Allies) ও কেন্দ্রশক্তি (Central Powers)।   কেন্দ্রশক্তিতে ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি, বুলগেরিয়া ও অটোম্যান সাম্রাজ্য (মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ অঞ্চল যার অন্তর্ভূক্ত ছিল); অন্যদিকে মিত্রদের মধ্যে ছিল যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সার্বিয়া, ফ্রান্স, ইটালি, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্র।

১৯১৫ সালের শেষের দিকে ঘটনা। তখনও বিশ্বযুদ্ধের জয়-পরাজয়ের কোনো রূপরেখা ফুটে ওঠেনি। এরই মধ্যে যুদ্ধোত্তর মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট ভাগাভাগিতে নেমে পড়ে সে সময়ে মিত্রশক্তির দুই প্রভাবশালী দেশ- যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। পরে রাশিয়া এই ভাগ-বাটোয়াতে অংশগ্রহণ করে। মধ্যপ্রাচ্য এ ভাগাভাগির মূল দায়িত্ব এসে পড়ে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের দুই কূটনীতিকের উপর। এদের একজন মার্ক সাইকস (Mark Sykes) আর অন্যজন জর্জ পিকট (Georges-Picot)। এদের মধ্যে কর্নেল সাইকস ভাড়াটে বৃটিশ কূটনীতিক আর পিকট ছিলেন ‘অপরিণত’ পেশাদার ফরাসি কূটনীতিক। সামরিক-বেসামরিক যৌথ মস্তিস্কে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে জঘণ্যতম যে গোপন দলিল লেখা হয়েছিল তা ‘সাইকস-পিকট চুক্তি’ (অফিশিয়ালি ‘এশিয়া মাইনর চুক্তি’) বা মধ্যপ্রাচ্য ভাগাভাগির গোপন চুক্তি নামে পরিচিত। রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনের (১৯১৭) নেতারা এ চুক্তি গ্রহণ করেনি বলে তা তারা প্রকাশ করে দিয়েছিল।

সাইকস ও পিকট মিলে ভূ-মধ্যসাগরের উপকূল থেকে শুরু করে ইসরাইলকে দু’ভাগ করে সিরিয়া-জর্ডানের সীমারেখা ধরে সোজাসুজি ইরাকের মসুল নগরীর নীচ ও কিরকুকের উপর দিয়ে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত মোটামুটি একটি সরল রেখা টেনে মধ্যপ্রাচ্যকে দু’ভাগে বিভক্ত করে। উপরের অংশে অবস্থিত তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাংশ, সিরিয়া, ইরাকের মসুল, লেবানন চলে যায় পিকটের (ফ্রান্সের) পকেটে আর নিচের ইসরাইলের দক্ষিণাংশ, জর্ডান, ইরাক, কুয়েত ও সৌদি আরবের পারস্য উপকূলীয় অংশ নেয় সাইকস (যুক্তরাজ্য)। এ ভাগাভাগিতে রাশিয়ারও একটা অংশ ছিল। সে তুরস্কের পশ্চিমাংশ ও ইস্তানবুল নিয়ে নেয়। চুক্তির বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে আরেক মিত্রশক্তি ইটালি শেষমেষ (১৯১৭ সালে) তুরস্কের দক্ষিণে ভূ-মধ্যসাগরের উপকূলীয় ভূ-খণ্ডটুকু নিয়ে নেয়। এভাবে সাইকস-পিকটের এক চুক্তিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরস্ক থেকে মধ্যপ্রাচ্য (উত্তর আফ্রিকা ও সৌদি আরবের অধিকাংশ ভূ-খণ্ড বাদে) চার মিত্রশক্তির করতলে চলে আসে। এর পরের একশো বছর শুধুই রক্তপাতের ইতিহাস।

Sykes-Picot চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগাভাগি