একুশের এস্তেঞ্জায় এলাকাঁড়ি

মার্চ এলেই স্বাধীনতার মাস, ডিসেম্বরে বিজয়ের মাস, তেমনিভাবে ফেব্রুয়ারি এলেই শুনি ভাষার মাস। একই সঙ্গে টেলিভিশনের (অপ্রচলিত বাংলায় দূরদর্শন!) পর্দার কোণে কোণে ভেসে ওঠে অ, আ, ক, খ বা শহীদ মিনারের প্রতিচ্ছবি। অতটা বুদ্ধিজীবী নই যে স্বাধীনতা, বিজয়—এসব নিয়ে কথা বলব। তবে গাঁও-গেরামের বাংলাভাষী হিসেবে এ ভাষা নিয়ে দু-একটি কথা না বললে যেন মনের মধ্যে কেবলই খচখচ করে।

যখন স্কুলে যেতাম, ২১ ফেব্রুয়ারির (৮ ফাল্গুন বলতে পারলে ভালো লাগ) ভোরে শিক্ষক-শিক্ষয়ত্রীদের তাড়া খেয়ে জেবে (পকেট শব্দের অপ্রচলিত বাংলা!) চ্যাপ্টা গাঁদা, রঙ্গন আর গন্ধরাজ ফুল নিয়ে খালি পায়ে শহীদ মিনারে ছুটতাম। তারপরে সারা দিন খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতাম। গ্রামের জ্যেষ্ঠরা বলতেন, আজ চটি-জুতা পরা যাবে না৷ কারণ, সালাম-রফিকের আত্মারা আজ সারা দেশে ঘুরে বেড়াবে এবং তাঁদের তাজা রক্তে ভেজা পথ-ঘাট-মাঠ সকলই পুনশ্চ রক্তিমাভাব হয়ে উঠবে। বিশ্বাস আর ভক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে আস্তে আস্তে মাটিতে পা ফেলতাম আর মাঝেমধ্যে মাটির দিকে তাকিয়ে দেখতাম সত্যি সত্যি মাটি লাল হয়ে উঠেছে কি না। দিনে দিনে যতই বুঝতে শিখেছি, ওসব মিথ্যা ছিল, ক্রমে ক্রমে ততই কমেছে সেই শ্রদ্ধা, সেই ভক্তি—সবকিছুই। এটাই ভালো যে সেসব মিথ্যে ছিল৷ কেননা সালাম-রফিক-শফিউরের বিদেহী আত্মারা সত্যিই যদি ঘোরাঘুরি করত, আর বাংলা ভাষার এই অপাঙক্তেয় কদর্য ব্যবহার দেখতে পেত, তবে তাঁদের সেসব অতৃপ্ত বাংলা ভাষাত্মাদের নিশ্চয়ই বশীভূত করে রাখার প্রয়োজন হতো। তখন আমার মতো সব অবাঞ্ছিত বাঙালির এমন কিছু স্লোগান থাকত—‘আমরা সবাই হ্যাংলা, দূর করি বাংলা’, ‘দুই আনা আধুলি, বাংলা খেদানোর মাদুলি’।

একুশ এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে মাতামাতি হয়, এটা আর নতুন কিছু নয়। প্রখ্যাত কলাম লেখকেরা কেউ কেউ ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্যের পূর্বাপর নিয়ে কপচানো শুরু করেন আবার কেউ-বা বাংলা কতটা রসাতলে গেছে, সেই রসের অতলতা পরিমাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমার মতো চুনোপুঁটিরাও বাদ যান না। তাঁরা বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁদের গর্বের কথা বলেন, তত্ত্বের কথা বলেন, শঙ্কার কথা বলেন, অভিমানের কথা বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের কথা বলেন, বাংলার দীনতা তুলে ধরেন, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এভাবে একুশ পার হয়ে যায়…সালাম-রফিকের আত্মারা দুর্গা মায়ের মতো বিসর্জনের মাধ্যমে আবার তাঁদের ঘরে ফিরে যায়।

পরবর্তী প্রজন্মের সালাম-রফিকের উদ্যোগে মহান শহীদ দিবসের সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস—শহীদ দিবসের রাজনীতিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিষয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রয়াত হ‌ুমায়ূন আজাদের একটি সাক্ষাৎকার হতে উদ্ধৃতি দেই…‘পৃথিবীর বহু অঞ্চলে বহু অসাধারণ ভাষা ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে, তাদের সাহিত্য লুপ্ত হচ্ছে প্রতাপশালী ভাষার চাপে। এটাকে প্রতিহত করা দরকার, প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনা হচ্ছে এই।’ মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রাম করেছে, রাজপথে রক্তের আলপনা এঁকেছে, এমন একটিমাত্র জাতি হচ্ছে বাঙালি আর এ সংগ্রামের সবচেয়ে চূড়ান্ত দিনটি হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। তাই পৃথিবীর সব দেশের সব মাতৃভাষা রক্ষার্থে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য নয়। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠাকরণ হলো বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণ আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন হলো প্রতাপশালী ভাষার আগ্রাসন হতে যেকোনো মাতৃভাষা রক্ষার অঙ্গীকারে সঞ্জীবনী সুধাদান। মহান শহীদ দিবসের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু সাধারণের অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন না বা করতে দেওয়া হয় না। এ হলো মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ববিষয়ক ভাবনা। এবার আসা যাক, শ্রদ্ধা নিবেদন বিষয়ে—সেই খালি পা, রক্তভেজা মাটিভ্রম আর শহীদ বেদিতে চ্যাপ্টা গাঁদা, রঙ্গন, গন্ধরাজ বিসর্জন।

মাঝে মধ্যে টিভির সামনে বসি, কমিউনিটি রেডিও শুনি। এসব গণমাধ্যমের উপস্থাপনা থেকে দু-একটি উদাহরণ দিই—‘ডিয়ার ভিউয়ার্স, আমাদের প্রোগ্রামে লাইভ কথা বলতে ফোন করুন স্ক্রিনে শো করা নম্বরগুলিতে’, ‘ফ্রেন্ডস, এখন শুনবেন অ্যা হট ফেভারিট সং’। বুঝতে কষ্ট হয় বলে চিন্তিত, ব্যথিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হই। এটা কি বাংলা, নাকি ইংরেজি, না মুখ বাঁকিয়ে নাক সিটকিয়ে ইংরেজি ঢঙে বলা বাংরেজি—‘সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। এরা এখন ইংরেজি দিয়ে বাংলার যতটা বস্ত্রহরণ করছে, পাকিস্তানি গোষ্ঠীরা উর্দু দিয়েও কখনো এতটা করতে পারেনি। কারণটা সবারই জানা৷ হুমায়ুন আজাদ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি৷ ‘বাংলাদেশে যদিও ভাষা আন্দোলন হয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারির মতো একটি মহান দিবস রয়েছে এবং এ আন্দোলন থেকে আমাদের স্বাধীনতাও আমরা পেয়েছি, কিন্তু বাংলাদেশে মাতৃভাষার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, অত্যন্ত বিপন্ন বাংলা ভাষা। বাংলা এখানে ক্ষমতার ভাষা বা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জনের ভাষা নয়। বাংলা এখানে নিতান্তই নামমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং জনগণের ভাষা। আমরা প্রধানত বাংলা ব্যবহার করি দৈনন্দিন যোগাযোগে। আমাদের প্রশাসনে, সেনাবাহিনী ও ব্যবসায় বাংলা নেই অর্থাৎ যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তির এলাকা, সেখানে বাংলা নেই। একজন ইংরেজি ভালো জানে, এটা এ দেশে তার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ইংরেজি ভালো জানে বলে সে ভালো চাকরি পেতে পারে কিন্তু একজন ভালো বাংলা জানে বলে ভালো চাকরি পাবে, এটা কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেনি। বাংলাদেশে ইংরেজি হচ্ছে ক্ষমতা, অর্থ, গৌরব ও সামাজিক সম্মানের ভাষা। বাংলা হচ্ছে শক্তিহীনতা, অগৌরব ও সামাজিক অসম্মানের ভাষা। যে দু’চার লাইন ইংরেজি পারে, রাগ করলে সেও ইংরেজি বলে, বাংলা নয়।

নিঃসন্দেহে ইংরেজি বাংলা ভাষার পরিপূরক হতে পারে, তবে প্রতিস্থাপক নয়। এটি কখনোই আমাদের মাতৃভাষার চালকের স্থানে বসতে পারে না। বাংলার আজকের এ অধোগতির জন্য ভাষাজ্ঞান, ভাষার ব্যবহারিক প্রসারতা বৃদ্ধি, গবেষণা, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে আইনি কার্যক্রম এসবের চেয়েও যেটি বেশি দায়ী, তা হলো ভাষায় আমাদের উদাসীনতা। ফলে প্রয়োজনের তাগিদে ভাব প্রকাশে আমরা অবচেতন মনে ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। বাংলা পারিভাষিক শব্দাভাবে এ প্রবন্ধে বাঁকা ছাদের অক্ষরে প্রতিকৃত অন্যান্য কতক ইংরেজি শব্দের মতো ওই ভাষার আরও কিছু শব্দেরও বাংলা পারিভাষিক শব্দ জানতে খুব ইচ্ছে করে, যেমন: ডিজিটাল, ইন্টারনেট, ডায়াল করা, ফোন/কল করা, ওয়েব ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো, এ দেশে কোনো বাংলা শব্দের ইংরেজি বলতে না পারাটা লজ্জার হলেও কোনো ইংরেজি শব্দের বাংলা বলতে না পারাটা মোটেও বিব্রতকর নয়, বরং একটু অহমিকার। ভাবটা এমন যে ওটা না জানলেও চলবে৷

প্রথম প্রকাশকাল– ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সম্পর্কিত অন্যান্য ব্লগ