রত্ন পাথর নিয়ে আমাদের আগ্রহের কোন সীমা-পরিসীমা নেই।
সুখের পাশাপাশি মানুষের জীবনে দুঃখ রয়েছে। সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতা। জীবনে সবাই সুখী হতে চায়, সফলতা পেতে চায়। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। এই নেতিবাচক পরিস্থিতিকে এড়াতে অনেক মানুষ জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করে। এ বিশ্বাসের হাত ধরে কেউ কেউ বিভিন্ন রত্নপাথর ব্যবহার করে। তবে রত্নপাথর ব্যবহারে ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে এমন বিশ্বাসের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবুও, রত্নপাথরকে ঘিরে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বিশ্বাস এখনো টিকে আছে।
বিশ্বাস যাই হোক, বিজ্ঞান যাই বলুক, পৃথিবীর সব দেশে হাতের আঙ্গুলের আংটিতে, গলার হার, কবজির ব্রেসলেটে বা কানের দুলে রত্নপাথরের ব্যবহার ছিল, আছে বা থাকবে। মজার কথা, পৃথিবীর নানা দেশে বহু বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ, এমনকি বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত সৌভাগ্যলাভের আশায় নানা ধরনের রত্নপাথর ব্যবহার করে।
রত্নপাথরের প্রতি প্রায় সবারই কৌতুহল আছে। দু’চারটি রত্নপাথরের নাম জানেন না এমন মানুষ এ সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রত্নপাথর নিয়ে কৌতুহলি মানুষদেরকে বিভিন্ন রত্নপাথর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা প্রদানের নিমিত্তে এই আয়োজন।
রত্ন পাথর – রুবি বা চুনি
চুনা পাথরের ভিতরে রুবি পাথরের জন্ম হয় বলে একে চুনি বলে। এর আরেক নাম রত্নরাজ। ফারসি ও আরবিতে এটিকে ইয়াকুত বলে, সংস্কৃততে বলে পদ্মরাগ। চুনি বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে- বাদামী লাল, কালচে লাল, কমলা, কালচে গোলাপি ইত্যাদি। উৎকৃষ্ঠ চুনির রং লাল। মায়ানমার ও শ্রীলংকার চুনির খ্যাতি আছে। জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে চুনি রবি গ্রহের রত্ন।
রত্ন পাথর – স্পিনেল
চুনি পাথরের সারা জীবনের শত্রুর নাম স্পিনেল। এটা দেখতে এতটাই চুনির মতো সহজে কেউ তা আলাদা করতে পারে না। স্পিনেল রত্নপাথর হলেও চুনির মতো দামী নয়। তাছাড়া, চীন কৃত্রিম উপায়ে স্পিনেল তৈরি করে বাজারজাত করে যা চুনির নামে বিক্রি হয়।
রত্ন পাথর – এমেথিস্ট বা পদ্ম নীলা
পদ্ম নীলা রাজভক্ত নীলা বা অপরাজিতা নীলা নামেও পরিচিত। পদ্ম নীলার সবচে প্রচলিত রঙ হচ্ছে গাঢ় বেগুনী। জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে পদ্ম নীলা শনি গ্রহের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।
রত্ন পাথর – টোপাজ বা পোখরাজ
পোখরাজ বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে- লাল, হলুদ, ধূসর, রক্তাভ কমলা, নীলচে বাদামি, সাদা, সবুজ, নীল, সোনালি, গোলাপি, রক্তাভ-হলদে ইত্যাদি। এদের মধ্যে কমলা পোখরাজ সবচেয়ে বিরল ও দামি। শ্রীলঙ্কার পোখরাজ বিখ্যাত। জ্যোতিষ শাস্ত্রে পোখরাজ বৃহস্পতি গ্রহের রত্ন।
রত্ন পাথর – টাইগার’স আই বা বাঘ্রাক্ষী
বাঘ্রাক্ষী দেখতে বাঘের ডোরা কাটা হলুদ-কালো দাগের মত। এ জন্য একে টাইগার’স আই বলে। এটি অস্বচ্ছ পাথর।
রত্ন পাথর – অ্যাকুয়ামেরিন বা সবুজ পান্না
সবুজ পান্না হালকা ঘন সবুজ বর্ণের স্বচ্ছ, দীপ্তিপূর্ণ ও সুশ্রী রত্নপাথর। কখনও কখনও হলদে নীল ও হালকা সাদা বর্ণেরও পাওয়া যায়। এই রত্নপাথরটিকে উর্দুতে বলে বৈরোজ। এটাকে অনেকসময় টোপাজের মতো মনে হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এটা পান্নার বিকল্প রত্ন হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
রত্ন পাথর – পার্ল বা মুক্তা
বর্ণের দিক থেকে মুক্তা সাদা, হরিদ্রাভ, কৃষ্ণাভাযুক্ত ও রুপালী আভাযুক্ত হয়ে থাকে। আরবীতে একে লুলুউ বলে। সাধারণত ঝিনুকের মধ্যে মুক্তা পাওয়া যায়। বালিকনা যখন ঝিনুকের দেহে ঢুকে পড়ে, তখনই তাকে ঘিরে স্তরে স্তরে ঝিনুকের রসক্ষরণ হয়। সেটাই কালক্রমে পরিণত হয় মুক্তায়। এ ধরনের মুক্তা শুক্তি মুক্তা বা মাদার অভ পার্ল নামে পরিচিত। এই মুক্তাটিই বাজারে সবচেয়ে বেশী প্রচলিত।
সমুদ্রচারী এক ধরনের শঙ্খের মধ্যে জন্মায় শঙ্খমুক্তা বা কঙ্কপার্ল। এগুলি গোলাপী রঙের ও বেশ দামী। শোনা যায়, বিশেষ এক বনবিহারী অজগর ও ব্যাঙের মাথায় মুক্তা পাওয়া যেত। বুড়ো হাতীর দন্তকোষ ও মস্তিষ্কে নাকি গজমুক্তা গজাতো, গভীর সাগরের তিমি মাছের মাথায় জন্মাতো মৎস্যমুক্তা। আজকাল মুক্তার কৃত্রিম চাষ শুরু হয়েছে। সেগুলোকে বলে কালচার্ড পার্ল। জাপান ও ভারতে এই ধরণের কৃত্রিম মুক্তা প্রচুর উৎপন্ন করা হচ্ছে।
ফ্রান্সের রাজমুকুটে সাড়ে সাতাশ ক্যারেটের একটি মুক্তা ছিল, যার নাম লা রেইনি দেস পার্ল। ১৯৭২ সালে এই মুক্তাটি চুরি হয়ে যায়। ফরাসি সম্রাটের দরবারে আরও একটি বিখ্যাত মুক্তার নাম রিজেন্তে, ওজন ৩৩৭ গ্রেন।
প্রাকৃতিক উপায়ের পাওয়া সবচেয়ে বড় মুক্তাগুলোকে বারোক বলা হয়। উনিশ শতকে লন্ডন ও আমষ্টার্ডামের ব্যাঙ্কার হেনরি টমাস হোপের কাছে একটি বারোক মুক্তা ছিল। এর নাম ছিল হোপ পার্ল, ওজন ছিল ২৩১ ক্যারেট। মুক্তার তৈরি দামি গয়না হল ল্যুভ নেকলেস। ১৪৫-টি সুন্দর, উজ্জ্বল ও সমান আকারের মুক্তা দিয়ে এটা তৈরী করা হয়, ওজন ২০৭৯ গ্রেন।
সকল মুক্তার মধ্যে কালো মুক্তা বড় দুর্লভ। মেক্সিকো উপকূলে এ মুক্তা পাওয়া যায়।
রত্ন পাথর – ওপ্যাল বা গিরিবজ্র
গিরিবজ্র রত্নপাথরের দুটি কখনো এক রকম হয় না। রঙের বৈচিত্রই এ পাথরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটা মূলত আধাস্বচ্ছ রত্ন। এ পাথর বিভিন্ন রঙের ছোপে ছোপে তৈরি।
রত্ন পাথর – অনিক্স
অনিক্স সাধারণত কাল বর্ণের। তবে কিছু কিছু পাথর বাদামী ও সাদা বর্ণেরও দেখা যায়। তবে কম হলেও লাল, কমলা ও মধুবর্ণেরও অনিক্স পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, এ পাথর ভালবাসায় আবেগকে কমিয়ে দিতে সক্ষম এবং প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি করে। এ জন্য যারা অবৈধ প্রেম বা পরকীয়ায় লিপ্ত, তারা অবৈধ প্রেম ও পরকীয়া থেকে রক্ষা পাবার জন্যে নাকি অনিক্স পাথর ব্যবহার করতো।
রত্ন পাথর – মুনস্টোন বা চন্দ্রকান্তমনি
চন্দ্রকান্তমনি সাধারণত নীলাভ, গোলাপি, হলদে অথবা হলুদাভ বর্ণের ছোপের সাথে দুধালো সাদা বর্ণের আলোকভেদ্য পাথর। চন্দ্রকান্তমনি মেয়েলি পাথর হিসেবে বিবেচিত। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এই রত্নটি চন্দ্র গ্রহের রত্ন হিসাবে ব্যবহত হয়। মুক্তার বিকল্প হিসাবে অনেকে এটি ব্যবহার করে। শ্রীলংকা ও মিয়ানমারে পাওয়া যায় ঈষৎ স্বচ্ছ, নীলচে চন্দ্রিম আভাযুক্ত দামী চন্দ্রকান্তমনি। মাদাগাস্কার ও তানজানিয়াতেও উন্নতমানের চন্দ্রকান্তমনি পাওয়া যায়।
রত্ন পাথর – লেপিস লাজুলি বা রাজপট্ট
রাজপট্ট শীতল, ভারী ও নরম অস্বচ্ছ শ্রেণীর রত্ন। এর অপর নাম তৈলস্ফটিক রত্ন, সংস্কৃতে রাজাওয়ারত। রত্নটির প্রকৃত রঙ বেগুনী নীলের উপর সোনালী বা রূপালি আভাযুক্ত। কিছু কিছু রত্নের গায়ে ছাপা ছাপা রকমারী নীলরর্ণের ছোপ দেখা যায়। আর কোন কোন পাথরের বর্ণ এত ঘোর নীল যে দেখতে কালো মনে হয়। কৃষ্ণাভ নীল এবং গায়ে রক্তবর্ণের চুমকীও থাকে।
প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাগণ রাজপট্টকে সৌভাগ্যবর্ধন রত্ন হিসেবে ব্যবহার করতেন। কথিত আছে, মিশরের প্রধান বিচার কর্তারা গলায় চেইনের সাথে এই রত্ন পরিধান করতেন। মিশরের রাজা টুটেন খামেনের সমাধি ক্ষেত্রে এই পাথরের তৈরী নানা প্রকার আসবাবপত্র পাওয়া গেছে। এই পাথর দ্বারা প্রাচীন কালে বাসন পেয়ালা ও মহিলাদের অলংকার তৈরী করা হতো। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এটি একই সাথে শনি, রবি ও মঙ্গলের করাল থেকে রক্ষা করতে অদ্বিতীয়।
রত্ন পাথর – এজুরাইট
এজুরাইট দেখতে রাজপট্টের মতো। এ কারনে এজুরাইট ও রাজপট্টের মধ্যে পার্থক্য করা বেশ কঠিন। তবে এজুরাইট রাজপট্ট থেকে নরম ও ভঙ্গুর।
রত্ন পাথর – জ্যাসিন্থ, গার্নেট বা গোমেদ/ তামড়ি
গোমেদ স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, লালচে বাদামি অথবা হলুদাভ সবুজ বর্ণের পাথর। গোমেদ রত্নে জির্কোনিয়াম নামের ধাতু বেশি থাকলে তাকে বলে জ্যাসিন্থ। বর্ণের দিক থেকে জ্যাসিন্থ লালচে, হলদে আভাযুক্ত, বেগুনী, জলপাই রঙ- এর মত হয়ে থাকে। এর ভেতরের দিকে সুক্ষ্ম বুদ বুদ এর মত দেখা যায়। জ্যাসিন্থ কষ্টি পাথরে ঘষলে দাগ পড়ে না বা ক্ষয় হয় না।
গোমেদের সস্তা বিকল্পের নাম গার্নেট। তবে গার্নেট কম মূল্যের পাথর। গার্নেটকে তামড়ি পাথরও বলে। গার্নেটের সাথে জ্যাসিন্থের পর্থক্য বোঝা বেশ কঠিন।
রত্ন পাথর – তারকোয়েজ বা তুত্থকমণি বা ফিরোজা
তুত্থকমণি রত্নপাথরটিকে সংস্কৃতে পায়বজ এবং ফারসীতে ফিরোজা বলে। ইরানী ফিরোজা বিখ্যাত। তুত্থকমণি বর্ণের দিক থেকে সবুজ বা উজ্জ্বল আসমানী নীল। এটি অস্বচ্ছ পাথর। পারস্য মাকড়সা জাল নামে বিখ্যাত এক ধরণের ফিরোজায় নীল রঙের ওপর সরু কালো রেখা জাল বিস্তৃত থাকে। রত্নটিকে পশ্চাৎ অংশ অমসৃণ ও কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হতে পারে। খ্রীষ্টপূর্ব চার হাজার বছর আগেও মিশরে এর ব্যবহার ছিল। আজকাল অস্বচ্ছ কাঁচকে রঙিন করে অথবা প্লাষ্টার অব প্যারিসকে রঙিন করে নকল ফিরোজা তৈরী করা হয়।
রত্ন পাথর- এমারেল্ড বা পান্না
পান্নাকে আরবি/ ফার্সিতে জমরুদ ও সংস্কৃতে মরকত পাথর বলে। পান্না মধ্যম থেকে গাঢ় সবুজ রঙের রত্নপাথর। ষড়ভূজাকৃতির কেলাস আকারে এটি পাওয়া যায়। বেশির ভাগ পান্নাই ঘোলাটে বর্ণের এবং খুঁতযুক্ত। নিখুঁত ও সুন্দর পান্না খুবই দামি রত্ন। পান্না সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কলম্বিয়ার মুজো এবং এল সিভর খনিতে।
পর্তুগাল হতে ব্রাজিলে বিতাড়িত রাজা ষষ্ট জনের পুত্র ডন পেড্রো পর্তুগাল ফিরে পাবার সমর্থন আদায়ে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে ডেভোনশায়ারের ডিউক উইলিয়াম ক্যাভেনডিশকে ১৩৮৩.৯৩ ক্যারেটের একটি পান্না উপহার দেন। এটি ডেভোনশায়ারের পান্না নামে খ্যাত।
রত্ন পাথর – জিরকন
জিরকন ভারী, উজ্জ্বল, মসৃণ ও সুদর্শন পাথর। প্রতিসরণাংকের আর বর্ণচ্ছটার দিক থেকে জিরকন হীরার পরের স্থান দাবি করতে পারে। এটি কৃষ্ণনীল, পীতশ্বেত, রক্তাভ, মরকত দ্যুতি, সাদাটে কপোতবর্ণ, ময়ূরকন্ঠের ন্যায় বিচিত্র বর্ণের হয়ে থাকে। ল্যাবরেটরীতে কাঠ কয়লা বা গ্রাফাইট কার্বনকে প্রচন্ড তাপে ও চাপে ফেলে জিরকন প্রস্তুত করা হয়। এগুলোকে বলা হয় কেমিক্যাল হীরা।
রত্ন পাথর – ডায়ামন্ড বা হীরা
‘আলো-ঝলমলে’ ধাতু হীরা পৃথিবীতে অন্যতম দুস্প্রাপ্য ও মূল্যবান রত্নপাথর। হীরাকে আরবীতে অলম্পাস বলা হয়। হীরার বহুতলে আলো বারংবার একে বেকে যায় বলেই এ থেকে তৈরী হয় বহুরঙা আলোর ফোয়ারা। হীরা গ্রাফাইটের সমগোত্রীয় অথচ বিপরীত ধর্মী। গ্রাফাইট নরম, হীরা অতীব কঠিন। খনি থেকে পাওয়া হীরা উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় থাকে না। হীরা না কাটলে তার ভেতরকার জৌলুস প্রকাশ পায় না। একে কেটে পলিশ করে উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় করে গড়ে তোলা হয়। খনি থেকে তোলার পর ৮০ ভাগ হীরাই কাটিং-এ বাতিল হয়ে যায়। বাকী ২০ ভাগ সেটিং, ওজন, বর্ণ, গঠন ও শুদ্ধতা অনুযায়ী শ্রেণীভুক্ত করা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার কিম্বার্লীতে বৃহত্তম হীরা খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানকার হীরা সুন্দর ও ঝলমলে। কিম্বার্লী একাই বর্তমান পৃথিবীর ৯০ ভাগ হীরার চাহিদা পূরণ করছে। ১৯৭৯ সালে পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়ায়আরেকটি বড় হীরার খনি আবিষ্কৃত হয়। ১৯৮৮ সালে অষ্ট্রেলিয়াতে ৩৪ মিলিয়ন ক্যারেট হীরার খনির সন্ধান পাওয়া যায়, যা গোটা পৃথিবীর মোট হীরার তিন-চতুর্থাংশের সমান।
কোহিনূর নামে একটি বিখ্যাত হীরা আছে। এ হীরার ইতিহাস অতি দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য। এ হীরার ওজন ১০৮.৯৩ ক্যারেট। প্রাচীনকালের সুন্দরী কুমারীর মতো এটিও বিভিন্ন রাজা বাদশাহ ও শাসকের হাত ঘুরে এখন স্থান পেয়েছে টাওয়ার অফ লন্ডনে।
রত্ন পাথর – ক্যাট’স আই বা বৈদুর্য্যমণি
বৈদুর্য্যমণি চকচকে উজ্জ্বল রত্ন। এর উপরের ভাগ পালিশ করা এবং নীচের পিট পালিশহীন হয়। এই রত্নটির উপর উজ্জ্বল আলোর সুতোর মত দাগ থাকে। রত্নটিকে নাড়ালে দাগগুলি নড়তে থাকে। একে বলে শ্যাটয়নসি (Chatoyancy)। বৈদুর্য্যমণিকে আরবীতে লহসনিয়া বলে। এটি বর্ণের দিক থেকে সবুজ, সাদা আভাযুক্ত ও ছাই রঙ এর হয়। আসল বৈদুর্যমণি কষ্টি পাথরে ঘর্ষণ করলে বর্ণ ও উজ্জ্বলতা নষ্ট হয় না বরং লাবণ্য আরো প্রকাশ পায়।
রত্ন পাথর – কোরাল বা প্রবাল
প্রবাল অস্বচ্ছ রত্ন। এর অনেক নাম আছে। একে ফার্সী ও আরবীতে মারজান, ভারত ও নেপালে পলা, হিন্দিতে মুঙ্গা এবং সংস্কৃতে বিদ্রুম ভৌমরত্ন, অঙ্গারক মণি, রক্তাংগ, রক্তকন্দ, অম্বুধিবল্লভ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়।
প্রবাল গাঢ় নীল, লাল, গোলাপী, সাদা ও কালচে বর্ণের হয়। রক্তের মত লাল অথবা গাঢ় লাল বর্ণের প্রবালকে বলে রক্তপ্রবাল, গোলাপি বর্ণের প্রবালকে বলে গৈরিক প্রবাল ও সাদা বর্ণেরটিকে বলে শ্বেত প্রবাল।
বলা হয়, রক্তের মধ্যে লাল প্রবাল রেখে দিলে কিছু সময়ের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। রক্ত প্রবাল যদি খাঁটি হয় তবে তা গরুর খাঁটি দুধে তিন থেকে চার ঘন্টা ডুবিয়ে রাখলে দুধ লাল বর্ন ধারণ করে। তুলোর মধ্যে একটি লাল প্রবাল নিয়ে সুর্যের আলোয় তিন-চার ঘণ্টা রেখে দিলে তুলোতে আগুন লেগে যায়। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, মঙ্গল গ্রহের সমস্যা থাকলে এই রত্নপাথর ধারণ করতে হয়।
রত্ন পাথর – স্যাফায়ার বা নীলা/ নীলকান্তমণি
প্রবালের মতো নীলারও অনেক নাম আছে। নীলাকে হিন্দিতে নীলম, ফারসীতে কবুদ এবং সংস্কৃতে নীলাশ্ম, সৌপিপত্ন, ইন্দ্রনীল, তৃণগ্রাহী, মহানীল, নীলোৎপল ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়।
নীলকান্তমণি বা নীলা মুলত নীল রঙের হয়। তবে নীলা অন্য রঙেরও হয়ে থাকে। নীলা অপরাজিতা ফুলের মতো নীলাভ, রক্তাভ বা গোলাপী আভাযুক্ত, পীতাভ আভাযুক্ত ইত্যাদি নানা মিশ্রিত বর্ণের হয়ে থাকে। বলা হয়, একটি পাত্রে গরুর খাঁটি দুধ রেখে তার মধ্যে নীলা ডুবিয়ে রাখলে দুধের ভিতর থেকে নীলবর্ণের আভা বিচ্ছুরিত হতে থাকে। কাশ্মীরের ময়ূরকন্ঠী নীলা পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর নীলা।
রত্ন পাথর- পেরিডট
পেরিডট লেবুর ন্যায় সবুজ, সবুজের সাথে হলুদ আভাযুক্ত, জলপাই সবুজ বা গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এটি বুধের রত্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঈর্ষাপরায়নতা ঈর্ষাপরায়ন, ধ্বংসাত্নক আবেগের ক্ষেত্রে আবেগকে অবদমিত করার জন্য পেরিডট একটি উৎকৃষ্ট রত্নপাথর। প্রাচীন মিশরীর পুরোহিতরা ফারাওদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য এ পাথর পরিধান করতেন।
রত্ন পাথর – সান স্টোন বা সূর্যকান্তমণি
সূর্যকান্তমণি দেখতে লাল, উজ্জ্বল হলদে, হলদে লালচে, গোলাপি লালচে বর্ণের হয়ে থাকে। স্টার রুবির মতো এর একপাশ পালিশ করা থাকে। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এটা রবির প্রতিকারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
জেসপার
জ্যাসপার লাল, হলুদ বা বাদামি রংয়ের মধ্যম মানের পাথর বিশেষ। এ পাথরের অন্যতম প্রচলিত একটি প্রকারভেদের নাম কোকিয়া জেসপার। কোকিয়া জেসপার প্রাকৃতিকভাবে আগ্নেয়দীপ্ত জীবাশ্ম শেল এবং হেমাটাইট আয়রন পাথরের মিশ্রণ। এটি ভারতীয় স্ক্রিপ্ট পাথর, কোবরা জেসপার, আরবি স্ক্রিপ্ট নামেও পরিচিত।
ব্লাড স্টোন
জেসপার পাথরের উপর লাল লাল ফোটা বা ছোপ থাকলে সেটাকে ব্লাড স্টোন বলে। প্রাচীন কালে এটি বীরত্বের প্রতীক রত্নপাথর হিসেবে বিবেচিত ছিল। কথিত আছে, ক্রুশবিদ্ধ যিশু খ্রিষ্টের কয়েক ফোঁটা রক্ত জেসপারের উপর পড়লে ব্লাডস্টোনের সৃষ্টি করেছে।
জেইড
জেইড পাথর বলতে সাধারণত দুই ধরনের পাথরকে বোঝায়- নেফ্রাইট ও জেডাইট। এটি মূলত সবুজ রঙের হলেও লাল, কালো, হলুদ, রক্তবর্ণ, নীল, গোলাপী, ধূসর, কমলা ও সাদা রঙের জেইড পাথর রয়েছে। কালো পাথরের জেইড নেফ্রাইট নামে পরিচিত। চীনে সবচেয়ে বেশি জেইড পাওয়া যায়।
আগেইট বা আকীক
আকীক পাথর লাল, কালো, হলুদ, খয়রি, সাদা, সবুজ বা বিভিন্ন রংয়ের মিশ্রণে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে লালটি ইয়ামেনি আকিক পাথর এবং সবুজটি পিত আকিক পাথর নামে পরিচিত। সাদা কালো রেখা যুক্ত আকিক পাথরকে বলা হয় সোলেমানি আকিক। জ্যোতিষ শাস্ত্রে আকীক পাথর ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয় যে, আকিক পাথর ব্যবহারে মন পবিত্র হয়। মনের ভেতরকার অন্যায় কামনা, বাসনা দূর হয়।
এম্বার বা অম্বর
অম্বর গাছের জীবাশ্ম থেকে তৈরি হওয়া পাথর। এটি সাধারণত হলুদ, কমলা, নীল, সবুজ এবং বাদামী রঙের হয়। বিরল হলেও লাল ও কালো রঙের অম্বর রয়েছে। প্রাচীনকালে অম্বর যথেষ্ট মূল্যবান পণ্য ছিল। তবে সময়ের সাথে এর মূল্য কমেছে। বাল্টিক সাগরে প্রচুর অম্বর পাওয়া যায়।
সাইট্রিন বা লেবু পাথর
সাইট্রিন সোনালী, উজ্জল কমলা বা হলুদ রঙের পাথর। আশ্চর্যজনকভাবে তবে বহু শতাব্দী ধরে এই পাথরের কোনও নাম ছিল না। ১৮তম শতাব্দীতে এটিকে সাইট্রিন নামে অভিহিত করা হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রে সাইট্রিন ব্যবসায়ে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। প্রাক-বিপ্লবী রাশিয়ায়, সর্বদা ঘোরাঘুরি করা ব্যবসায়ী বা জুয়াড়ীরা সাইট্রিনকে তাবিজ হিসাবে ব্যবহার করতো।
কারনেলিয়ান
কারনেলিয়ান এর বর্ণ লালচে কমলা অথবা বাদামি। এটি অস্বচ্ছ কিন্তু আলোক প্রবাহি। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এটি ক্যারিয়ার পাথর হিসেবে পরিচিত। অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক, বক্তা, সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ব্যক্তিরা এ পাথর ব্যবহার করে।
টুরমালিন
টুরমালিন এক ধরনে খ্রিস্টাল পাথর। এটি কালো, বাদামী, লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল রঙের হয়ে থাকে। বাদামী থেকে কালো টুরমালিন স্কর্ল, ঘন হলুদ হতে বাদামী টুরমালিন দ্রাভাইট, লাল বা গোলাপি টুরমালিন রুবেলাইট, সবুজ টুরমালিন ভেরদেলাইট বা ব্রাজিলের পান্না নামে পরিচিত। অনেকে সবুজ টুরমালিনকে ভুল করে পান্না মনে করে।
তানজানাইট
তানজানিয়ার মানইয়ারা অঞ্চলের মিরেরানি পাহাড়ে তানজানাইট পাওয়া যায়। বেগুনী-নীল রঙের এ পাথর বর্তমান বিশ্বের সবচে’ মূল্যবান রত্নপাথর।
বাজারে নানা রকমের রত্নপাথর পাওয়া যায়। এগুলোর রং আর উজ্জল বর্ণচ্ছটার আভা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু এত সব রত্নপাথরের ভিড়ে কোনটা আসল, কোনটা নকল তা চিনতে পারা দুঃসাধ্য। রত্নপাথর আসল, নাকি নকল বুঝার জন্য রত্নপাথরের আকৃতি, রঙ, স্বচ্ছতা, কাঠিন্য, প্রতিসরণাংক, বিচ্ছুরণ, আপেক্ষিকগুরুত্ব ও এদের ভেতর যে সব অবাঞ্চিত সুক্ষ্ণ পদার্থ থাকে তার বিন্যাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরি করতে হবে। রত্নপাথরের প্রতিসরণাংক জানা থাকলে রত্নপাথরের সঠিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব। কারণ রত্নপাথরের নির্দিষ্ট প্রতিসরণাংক এর হেরফের বিশেষ দেখা যায় না। এ ছাড়া বিচ্ছুরণ ধর্ম যাচাই করেও রত্নপাথর আসল কিংবা নকল তা যাচাই করা সম্ভব।
[বি.দ্র.- এই নিবন্ধ পড়ে এবং ছবি দেখে পাথর চিনতে পারবেন তা সঠিক নয়। তবে এটা বুঝতে পারবেন যে, পাথর চেনা সহজ নয়।]