Alexandre_Cabanel_-_The_Birth_of_Venus_-1863

কোনো দৃশ্য বা ঘটনা দেখার পরে আমাদের মনে তার একটা ছবি তৈরি হয়। পরবর্তী কোনো সময়ে সে দৃশ্য বা ঘটনা মনে পড়লে সেই ছবিটা আবছাভাবে ভেসে ওঠে। সেখানে খুব একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত বর্ণনা থাকে না। যেটা থাকে সেটা হলো সেই দৃশ্য বা ঘটনার একটি সার্বিক প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবির নাম অন্তর্মুদ্রা। ইংরেজিতে বলে ‘ইমপ্রেশন’ (impression)।

নিচের দু’জোড়া ছবি দেখতে পারেন। একজোড়াতে মোরগ লড়াই ও গ্রিক দেবী ভেনাসের জন্ম চিত্রিত হয়েছে। অন্য জোড়াতে সূর্যোদয় ও মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন।

যদি জোড়া ধরে চিত্রকলাগুলো তুলনা করি তবে দেখা যায়, এক জোড়াতে বিষয়বস্তু গ্রিক পুরাণ। সেখানে মানুষ, মোড়গ, ভেনাস ও দেবদূতগুলো সূচারুরূপে চিত্রিত। তাদের দেহসৌষ্ঠব সুনিপুণ। প্রতিটি বিষয়বস্তু অত্যন্ত ষ্পষ্ট এবং নিজস্ব রঙে অঙ্কিত। এগুলোতে গাঢ় চিকন চিকন তুলির আঁচড়গুলো বোঝা যায় না। মনে হয়, এগুলো যেন ক্যামেরায় তোলা রঙিন ছবি।

অন্য জোড়ায় বিষয়বস্তু সূর্যোদয় ও মধ্যাহ্নভোজ- আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মামুলি কিছু ঘটনা। ছবিগুলোতে সূর্য, নৌকা, মানুষ কোনোটাই আগের জোড়ার মতো নিখুঁতভাবে চিত্রিত নয়। বরং সবই একটা আবছা প্রতিচ্ছবি। এখানে ছোট ছোট তুলির আঁচড় বেশ গাঢ়। দেখলে মনে হয়, অসমাপ্ত শিল্পকর্ম। এগুলোতে প্রাকৃতিক দৃশ্যের পটভূমিতে হালকা রঙের ব্যবহারে প্রাকৃতিক আলোতে প্রতিটি বিষয়বস্তুকে তুলে ধরা হয়েছে।

১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি শিল্পকলায় প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠান ছিল- একাদেমি অভ ফাইন আর্টস (Académie des Beaux-Arts)। তারা সে সময়ে শিল্পের বিষয়বস্তু, রীতিনীতি ও গুণমান যাচাই-বাছাই করে নির্বাচিত চিত্রকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করতো।

এ একাদেমির বিজ্ঞজনেরা স্টুডিওতে মডেল রেখে ঘনকালো পটভূমিতে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও গ্রিকপুরাণের ঘটনাবলী নিয়ে নিখুঁত ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিত্রিত শিল্পকর্মকে প্রাধান্য দিত। এ ঘরানার শিল্পীদের চিত্রকর্মগুলোতে রৈখিক পদ্ধতিতে বিষয়বস্তুকে উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, গভীরতা, অবস্থান ও দূরত্বের হিসেব অনুযায়ী তুলে ধরা হতো। এ চিত্রনরীতিকে লিনিয়ার পারস্পেক্টিভ (linear perspective) বলা হয়।

ফ্রান্সের মতো ইংল্যান্ড, স্পেন, ইটালিসহ শিল্পমনা অনেক দেশে শিল্পকলায় গৎবাঁধা নিয়মের এ রাজত্বকাল একাদেমিসিজম (Academicism, 1560-1900) নামে পরিচিত। রেনেসাঁ উত্তরকালের এ একাদেমিসিজমের দীর্ঘ সময়ে ইউরোপে ম্যানারিজম, বারোক, নিওক্লাসিক্যাল, রোমান্টিসিজম, রিয়েলিজম নামে শিল্পকলায় বিভিন্ন  চিত্রনশৈলীর আবির্ভাব ঘটেছিল।

১৮৬০ সালে প্যারিসের একটা ঘটনা বলছি। শিল্পের মাপকাঠিতে যোগ্য বিবেচিত না হওয়ায়  একাদেমি অভ ফাইন আর্টস সে বছরের প্রদর্শনীর জন্য জমাকৃত বেশ কিছু চিত্রকর্ম বাতিল করে। বাতিল হওয়া সে সব শিল্পীরা একত্রিত হয়ে চিত্র, স্থাপত্য শিল্পীদের নতুন একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এদের মধ্যে  ক্লড মনে (Claude Monet), সিসলে (Sisley), সেজানে (Cezanne), রেনোয়া (Renoir) উল্লেখযোগ্য। এ সংগঠনটি ১৮৭৪ সালে প্যারিসে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

উপরের সূর্যোদয় ও মধ্যাহ্নভোজ বিষয়বস্তু নিয়ে যে জোড়া চিত্রকর্মের কথা বলা হয়েছে, ঐ প্রদর্শনীতে এ ধরণের সব চিত্রকর্ম প্রদর্শন করা হয়। সূর্যোদয় নিয়ে চিত্রকর্মটি এখানে প্রদর্শন করা হয়। এর নাম Impression, Sunrise (1872)। শিল্পী ক্লড মনে।

একাদেমির বিজ্ঞজনেরা ঐ প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলোর বেশ সমালোচনা করে। তারা এসব চিত্রশিল্পীদেরকে impressionist ব্যঙ্গ করেন। অথচ এর পরের ইতিহাস পুরাই উল্টো। নতুন প্রজন্মে কাছে এ চিত্রনরীতি জনপ্রিয়তা লাভ করে। শিল্পকলায় নতুন এক বিল্পবের শুরু হয়। নাম অন্তর্মুদ্রাবাদ বা Impressionism।  

ক্লড মনের চিত্রকর্ম থেকে নামকরণ হলেও অন্তর্মুদ্রাবাদ চিত্রনশৈলীর শুরু হয়েছিল ক্যামিল পিসররোর (Camille Pissarro) হাত ধরে। তথাকথিত স্টুডিওর বাইরে উন্মুক্ত প্রান্তরে এসে তার আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের শিল্পকর্মগুলো মনে ও সেজানের মতো শিল্পীদের প্রভাবিত করেছিলো।

অন্তর্মুদ্রাবাদ চিত্রনশৈলীর কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং গ্রামীণ ও শহুরে জীবনযাপনের মামুলি ঘটনাবলী এ শিল্পকর্মের মূল বিষয়বস্তু। অনেকটা ঘটে যাওয়া জীবনের সাধারণ কোনো ঘটনার এক ঝলক আবছা-অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। উন্মুক্ত পরিবেশে প্রাকৃতিক আলোয় গাঢ়মোটা ছোট ছোট হালকা সব রঙের তুলির আঁচড়ে এ শিল্পকর্ম তৈরি হয়।  মূলত কোনো বিষয়বস্তু আসলে দেখতে কেমন এ সব শিল্পীরা সেটা তুলে ধরে না। কোনো একটি সময়ে কোনো দৃশ্যপট কিভাবে প্রতিভাত হয় আবছাভাবে সেটা তুলে ধরাই অন্তর্মুদ্রাবাদ চিত্রকলার মূল লক্ষ্য।

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পকলায় অন্তর্মুদ্রাবাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।

One thought on “রেনেসাঁ উত্তরকালে ইউরোপীয় চিত্রকলায় অন্তর্মুদ্রাবাদী বিপ্লব”