গত বারো বছর আগেও এমন ছিল না। মানুষ বিসিএস নিয়ে এত উৎসুক ছিলো না। গত এক দশক ধরে বিসিএস নিয়ে বেকারদের উৎসাহ এক ধরনের উন্মত্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছে। উন্মত্ততা এখন তো দেখি মাদকতায় রূপ নিয়েছে।
গত এক দশকে যে পরিমাণ মানুষকে সরকারি চাকুরীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। এমনকি এত অল্প সময়ে এত বেশি বিসিএসে নিয়োগও কোনদিন হয়নি। এর পরে আছে বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে নিয়োগ। এছাড়া প্রাইমারি শিক্ষক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকেও নিয়োগ কম হয়নি বা হচ্ছে না। তারপরেও ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বেকারের সংখ্যার সাথে চাকুরীর সংখ্যা পারছে না। পারার কথাও না, পৃথিবীর খুব কম দেশে এটি সম্ভব হয়েছে।
আমাদের শিক্ষাজীবনের অন্যতম লক্ষ্য একটা ভালো চাকুরী। আমাদের সংজ্ঞায় ভালো চাকুরী হলো যথেষ্ট বেতন, ‘ভিআইপি’ মর্যাদা, চাকুরীর নিরাপত্তা, সামাজিক প্রতিপত্তি, সম্মান ও ক্ষমতা। এ সবকিছু মিলিয়ে বিসিএস চাকুরী এখন পর্যন্ত যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী তা নিয়ে খুব বেশি সন্দেহ প্রকাশের সুযোগ নেই।
এটি কিন্তু স্বতঃসিদ্ধ সত্য নয়। বিসিএস ক্যাডার হওয়া যে কারো জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি নয় তাও অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। নামকরা ক্যাডারে চাকুরি পেয়েও শিক্ষকতা পেশায় থেকে যাওয়া, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বা একেবারে পাড়ি জমানো, নিজের পুরানো চাকুরিতে বহাল থাকা … এ সবের উদাহরণ একেবারে কম নেই।
তবে বিসিএস কেন মাদকতায় রূপ নিয়েছে? ইন্টারমিডিয়েট থেকে, অনার্স ফাস্ট ইয়ার থেকে ছেলেমেয়েরা এখন বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তারা একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে বিসিএসের পড়াশোনার প্রতি এত বেশি ঝুঁকে পড়ছে যে অনার্স-মাস্টার্সে ভালো রেজাল্টের চেয়ে প্রিলি-লিখিত পাশ করার এখন গুরুত্ব অনেক বেশি।
কিভাবে ছড়িয়ে পড়লো এ নেশা? দীর্ঘ একটি সময় ধরে বিসিএস প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকার কারনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি কয়েকটি কারণ তুলে ধরতে পারি। এক. প্রতিবছর এক বা একাধিক বিসিএসের সার্কুলার; দুই. পিএসসির অবিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়া; তিন. ভাইভায় পাশ করলে প্রাপ্ত নম্বরের সিরিয়ালের ভিত্তিতে নন-ক্যাডারে নিয়োগ; চার. প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা পরীক্ষার্থীদের অবাধে বিসিএসে নিয়োগ; পাঁচ. বিসিএস কোচিং করানো প্রতিষ্ঠানসমূহের সংখ্যা ও প্রচারণা বৃদ্ধি; ছয়. সর্বসাধারণের উপযোগী বিসিএস সিলেবাস; সাত. নিয়মিত বিসিএসের ফল প্রকাশ (ইদানিং এ ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষণীয়); আট. সোশাল মিডিয়ায় জনকল্যাণের নামে বিসিএস “লিজন্ড”দের প্রচারণামূলক মোটিভেশনাল স্পীচের ছড়াছড়ি; নয়. সরকারি চাকুরিতে যথেষ্ট বেতন বৃদ্ধি।
আমি কখনোই বলি না, বিসিএসের এ নেশা ভালো নয়। আমার ভাবনায় এ নেশার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় এসেছে। একটি সাধারণ বিসিএসে এখন পরীক্ষা দেয় চার থেকে পাঁচ লাখ। ধরা যাক, এদের মধ্যে থেকে বিসিএস, অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সব মিলিয়ে এক লক্ষ লোক চাকুরি পাবে। বেকার থেকে যাবে চার লাখ। এক দিনে এ চার লাখের চাকুরীর বয়স যেমন শেষ হবে না তেমনি এ সংখ্যার সাথে প্রতি বছর আরো লাখ খানেক শিক্ষিত বেকার যে যোগ হবে না তাও বলা যাবে না। সব মিলিয়ে প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ ৩০ বা ৩২ এর কোটা পার করছে। এ সংখ্যা যে একেবারে নগণ্য নয় সেটা সরকারি চাকুরীতে বয়স বাড়ানোর আন্দোলন থেকে বেশ অনুমান করা গেছে।
কি হচ্ছে এসব তরুণদের ভবিষ্যৎ? ভার্সিটি পাশ থেকে শুরু করে বছর পাঁচেক এরা বিসিএসের গণ্ডিবদ্ধ মুখস্তনির্ভর পড়াশোনায় নিমজ্জিত থাকে। এদের মধ্যে চাকুরী নামের সোনার হরিণ যাদের হাত থেকে ফসকে যায় তাদের অধিকাংশরা হতাশাগ্রস্ত এক জীবনে প্রবেশ করে। এদের বেশিরভাগ যোগ্যতার তুলনায় কম বেতনের বেসরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। যারা এ ধরনের চাকুরীতে প্রবেশ করে তাদের প্রতিষ্ঠান মালিকেরা এ সুযোগটাকে যথেচ্ছাভাবে ব্যবহার করে। তাদের দিয়ে বেতনের অতিরিক্ত পরিশ্রম করায় এবং ৪২-৪৫ বছর বয়স পার হলে চাকুরী ছেড়ে দিতে বাধ্য করে কারণ ঐ সময়ে তার বেতনের টাকায় আরো দুই জন তরুণকে চাকুরীতে নিয়োগ দেয়া যায়। কর্পোরেট, পুঁজিবাদের দুনিয়ায় এ ঘটনাকে এখন আর অন্যায় বলা যায় না।
তাহলে বিকল্প কি হতে পারে? আমার মতে বিসিএস চাকুরীর চেষ্টার পাশাপাশি স্বনির্ভর ও সাবলম্বী হওয়ার কোন পথ তৈরী করা। যদি কোন চাকুরী না হয়, তবে সে গৌণ পথটাই যেন মূখ্য করে তোলা যেতে পারে তেমন একটি সুযোগ যেন খোলা থাকে।
মনে রাখতে হবে, যে লিজেন্ড যতই মোটিভেশন দিক না কেন, বিসিএস সবার হবে না, নন-ক্যাডারের জবও সবার হবে না। কারন একটাই এবং সেটা খুব সহজ একটা কারণ। কারণটা হলো বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা পদের সংখ্যা থেকে দুশো গুণেরও বেশি; অর্থাৎ প্রতি ২০০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিসিএস চাকুরী পাবে মাত্র ১ জন।
কয়েকটি উদাহরণ দিতে পারি, “আজকের বিশ্ব” বইটির লেখক কয়েকবার বিসিএস চেষ্টা করেছেন। হয়নি। তিনি কিন্তু থেমে যাননি। সফল হয়েছেন। বিসিএস দেবার যোগ্যতা ও চাকুরী পাওয়ার সর্ববিধ জ্ঞান সব থাকা সত্ত্বেও ’ওরাকল’ প্রতিষ্ঠানের মালিক কখনো বিসিএসের পেছনে ছোটেননি। প্রকাশনা ব্যবসায় নেমেছেন। কতশত মানুষ তার বই পড়ে ক্যাডার হচ্ছে, তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। কোনো ‘বিসিএস কনফিডেন্স’ এর মালিক বিসিএস দেয়নি। তাই বলে কি তাদের মোটিভেশনে লোকজন ক্যাডার হচ্ছে না? হচ্ছে, হয়তো আরো হবে।
এদের সবাই যে যার স্থানে মেধাবী। মেধাবী বলতে মনে পড়লো, এখন মেধাবীদের সংজ্ঞা পরিবর্তন এসেছে। এখন যে চাকুরী পায় সে মেধাবী, যার কোটা নেই সে মেধাবী। সর্বজনস্বীকৃত না হলেও এ ধারণা মোটামুটিভাবে সমাজে জেকে বসেছে। এ ধারণা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, হওয়ার কোন সুযোগও নেই।
স্বনির্ভর ও সাবলম্বী হওয়ার পথে অন্যতম একটি বাধা বিসিএস ক্যাডারদের মোটিভেশনাল স্পীচ। স্পীচের উদ্দেশ্য খারাপ নয়, তবে ফলাফলে ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। কীভাবে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। এটা ব্যাখ্যার জন্য এ ধরনের স্পীসের কিছু বৈশিষ্ট্য জানা প্রয়োজন।
সমগ্র স্পীচ একটি সাফল্য গাঁথা। সাফল্যের নাম বিসিএস চাকুরী পাওয়া। ………….. বিসিএস চাকুরী না পেয়ে মাছের পোনার ব্যবসা করে, ডেইরী ফার্ম করে, ডিমের ব্যবসা করে স্বনির্ভর ও সাবলম্বী হয়ে দেশের কত জনে কত ভাবে সাফল্য পেয়েছে এ ধরনের স্পীচে এ ভাবের বড় অভাব।
এ ধরনের স্পীচের বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে বিভিন্ন ক্যাডারের সুযোগ-সুবিধার গল্প। সেখানে গাড়ী থাকে, বাড়ী থাকে, নারী থাকে, চাকর-বাকর-আরদালী সবাই থাকে।…………….শুধু থাকে না এ চাকুরী না হলে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার অন্য কোন স্বনির্ভর নির্দেশনা।
আরেকটি অংশে থাকে নিজ জীবনকাহিনী। কিভাবে সফল হলেন সে সব জল্পনা-কল্পনার সাথে বাস্তবের চিটাগুড় মেশানো জবড়জং থাই খাবার যা থাইল্যান্ডেও বিরল। এখানে অবিবাহিত ও বিশেষ পোশাকধারী বা ধর্মের ঝাণ্ডাধারীরা স্ব স্ব গোষ্ঠী বিশেষের সাতিশয় আনকূল্য লাভের কারণে মাঝে মধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে ফেলেন।
আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি এ সব মোটিভেশনাল স্পীচের উদ্দেশ্য খারাপ নয়। অনেক সময় এগুলো ব্যবসায়িক বা আত্মপ্রচারণামূলক হলেও এতে যথেষ্ট জনকল্যাণমূলক প্রণোদনা রয়েছে। আমার মতে ঘাটতি কেবল দুটি বিষয়ে—এক. বিসিএস চাকুরী জীবনের একমাত্র সাফল্য নয়; দুই. শুধু “আপনি কেন পারবেন না?” নামক সস্তা প্রণোদনামূলক ডায়ালগের পরিবর্তে “আপনি কেন পারছেন না?” নিয়ে আলোচনা।
পরিশেষে একটি কথা দিয়ে শেষ করি। প্রত্যেকটা মানুষের জীবন স্বতন্ত্র, জীবন পরিক্রমাও। যেমন স্বতন্ত্র প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ, তেমনি কেউ কারো মতো নয়, কেউ কারো অনুরূপ নয়, প্রতিরূপও নয়। এটাই সৃষ্টির সবচে বড় রহস্য।
স্রষ্টা কিন্তু আপনাকে আরেক জনের মতো করে সৃষ্টি করেননি। তিনি প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করেছেন। এর অবশ্যই কোন কারণ আছে। স্রষ্টায় বিশ্বাস করলে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কেন স্বতন্ত্র? কিভাবে?
প্রথম প্রকাশকাল- ২৩ আগস্ট ২০১৯