শতকের প্রভাবশালী ব্যক্তি

দুই হাজার বছরের ২০ প্রভাবশালী ব্যক্তি

দুই হাজার বছরের পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতি শতকে এক এক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি জন্মেছিল। এ সকল ব্যক্তিরা সবাই আবার সেই শতক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত স্ব স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। প্রতি শতক থেকে এক জন করে দুই হাজার বছরের ইতিহাস হতে ২০ জনকে নির্বাচিত করে এই সংকলন।

যিশু খ্রিস্টঃ খ্রিস্টিয় ১ম শতকের সবচে প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম যিশু খ্রিস্ট। তাঁর প্রচারিত খ্রিস্টান ধর্ম এখনও বিশ্বের সর্বাধিক লোকের ধর্ম হিসেবে টিকে আছে।

মার্কাস অরেলিয়াসঃ ২য় শতকের সবচে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি ছিলো দার্শনিক রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস (Marcus Aurelius)। তিনি ছিলেন রোমান সুখের জীবন বা প্যাক্স রোমানার (Pax Romana) পাঁচ শাসকের শেষ জন। উত্তম শাসক ছাড়াও “নির্বিকার দর্শন” (stoicism) এর উপরে লেখা “Meditations” বইটির জন্যে তিনি চিরকাল অবিস্মরণীয় থাকবেন। 

ডাইওক্লেশিয়ানঃ ৩য় শতকের সবচে বিখ্যাত ব্যক্তিটিও রোমান শাসক- ডাইওক্লেশিয়ান (Diocletian)। একেবারে নীচু জাত থেকে উঠে এসে এই শাসক সমগ্র রোমান অঞ্চলকে চার শাসকের (ডাইওক্লেশিয়ান, ম্যাক্সমিলিয়ান, কনস্ট্যানটাইন, লিসিনিয়াস) অধীনে চারটি ভাগে বিভক্ত করে টেট্রার্কি (tetrarchy) প্রথায় ভগ্নপ্রায় বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের হাল ধরে ছিলেন। এছাড়া, তিনি প্রথম রোমান শাসক যিনি স্বেচ্ছায় শাসন ক্ষমতা থেকে সরে দাড়ান।

অগাস্টিনঃ ৪র্থ শতকে এসে যার কথা বলা আবশ্যক তাঁর নাম সুফী অগাস্টিন (Saint Augustine)। তিনি মূলতঃ এক জন খ্রিস্টিয় দার্শনিক ধর্মযাজক। তিনি পাশ্চাত্যের দর্শনে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক অণুপ্রবেশ ঘটান। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে The City of God, Confessions অন্যতম। 

থিওডোরিকঃ যে দুটি দুর্ধর্ষ জার্মান যাযাবর জাতির হাতে রোমান সাম্রাজ্যের সর্বনাশ হয়েছিল তাদের একটি অস্ট্রোগোথ (Ostrogoth) ও অন্যটি ভিসিগোথ (Visigoth)। এ দুই যাযাবর জাতি ও পরবর্তীতে রোমের শাসক মহান থিওডোরিক (Theodoric the Great) ছিল ৫ম শতকের সবচে প্রভাবশালী ব্যক্তি। পশ্চিমের আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পূবের আড্রিয়াটিক (Adriatic) সাগর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল।

গ্রেগরিঃ ৬ষ্ট শতকের সবচে বিখ্যাত ব্যক্তিটি রোমান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মযাজক, নাম সুফী মহান গ্রেগরি (Saint Gregory the Great)। তাঁর সময়ে ক্যাথলিকরা সারা ইউরোপ জুড়ে ধর্ম প্রচারে লিপ্ত হয়। তিনি Doctor of the Church নামেও খ্যাত ছিলেন। গ্রেগরির অন্যতম বৈশিষ্ট হলো তিনি খ্রিস্টধর্মের ক্যাথলিক, ইস্টার্ন অর্থোডক্স, এংলিকান, লুথেরান, ক্যালভিনিজম সব অংশেই সমাদৃত ছিলেন। 

হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ৭ম শতক ও পরবর্তী সকল সময়ের জন্য সবচে প্রভাবশালী ব্যক্তিটি আমাদের শেষ নবী, সর্বকালের, সর্ব সেরা মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। এতো স্বল্প পরিসরে তাঁর সম্পর্কে বলার চেষ্টা করা এক প্রকারের ধৃষ্টতাই বটে।

জুয়ানজংঃ চীনের ট্যাং (Tang) রাজবংশের সোনালী যুগের প্রণেতা ৭ম সম্রাট জুয়ানজং (Xuanzong) ছিলেন ৮ম শতকের সবচে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর সময়কালে ট্যাং রাজবংশ সংস্কৃতি ও শক্তির শীর্ষে অবস্থান লাভ করে। 

হারুন আল-রশিদঃ বাগদাদের খলিফা হারুন আল-রশিদ (Harun Al- Rashid) ছিলেন আব্বাসিয় বংশের ৫ম খলিফা ও ৯ম শতকের সবচে খ্যাতনামা ব্যক্তি। তাঁর শাসনামলে বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ব্যাপক ভাবে বিস্তৃতি লাভ করে বলে এ সময়কালকে ইসলামের স্বর্ণযুগের শীর্ষকাল বলে। তিনি ইরাকের বাগদাদে ”বায়তুল হিকমা” নামেে এক বিশাল গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সময়কালে আরব্য রজনীর “এক হাজার এক রাত” এর গল্প লেখা হয়। শিয়ারা তাঁকে তাদের ৭ম ঈমাম মুসা ইবনে জাফরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে।

আল-ফারাবিঃ এরিস্টটলের পরে রাজনৈতিক দর্শন, নীতিবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান, গণিত, সঙ্গীত, অধিবিদ্যা (metaphysics), মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ্যা (cosmology) ইত্যাদি বিষয়ের মুসলিম পণ্ডিত ”দ্বিতীয় শিক্ষক” নামে খ্যাত আল-ফারাবি (Al- Farabi) ছিলেন ১০ম শতকের সবচে আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাতে সমান সমাদৃত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কর্মের মধ্যে The Great Book Of Music, The Virtuous City, On The Introduction Of Knowledge, Classification Of Rhythms উল্লেখযোগ্য। 

দ্বিতীয় ব্যাসিলঃ খ্রিস্টিয় ৪র্থ শতকের শেষের দিকে রোমান সাম্রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়- ইটালিকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য রোম সাম্রাজ্য ও কনসট্যান্টিনোপলকে (বর্তমান তুরস্কের ইস্তানবুল) কেন্দ্র করে পূর্ব রোম সাম্রাজ্য। এই পূর্ব রোম সাম্রাজ্যকে বলা হয় বাইজাসনটাইন সাম্রাজ্য। এখানে গড়ে উঠেছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। বাইজানটাইন (Byzantine) সম্রাটদের মধ্যে সর্বাধিক সময়কাল ধরে শাসন করা দ্বিতীয় ব্যাসিল (Basil II) হলো ১১দশ শতকের সবচে প্রখ্যাত ব্যক্তি। খ্রিস্টিয় ৭ম শতকে রাশিয়ার ভলগা অঞ্চলে বুলগার (Bulgar) নামে এক দুর্ধর্ষ যাযাবর জাতির উদ্ভব হয় যারা বাইজেনটাইন সভ্যতার জন্য হুমকিসরূপ ছিল। দ্বিতীয় ব্যাসিল এই বুলগারদেরকে শক্ত হাতে দমন করে এ সভ্যতাকে সংহত করেন বলে তাঁকে “বুলগারের কসাই” (Slayer of the Bulgars) বলা হয়। 

সালাদিনঃ সিরিয়া ও মিশরের সুলতান, আয়ুবিদ (Ayyubid) রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহান কুর্দি যোদ্ধা সালাদিন (Saladin) ছিল ১২দশ শতকের প্রভাবশালী ব্যক্তি। ১১৮৭ সালের বিখ্যাত হাত্তিনের যুদ্ধে (Battle of Hattin) ক্রুসেডারদেরকে হারিয়ে তিনি প্যালেস্টাইন দখল করেন। 

চেঙ্গিজ খানঃ বিখ্যাত মঙ্গোলিয় সেনাধ্যক্ষ ও সেনাপতি চেঙ্গিজ খান (Genghis Khan) মঙ্গোল গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। তাকে মঙ্গোল জাতির পিতা বলা হয়ে থাকে। মঙ্গোল সাম্রাজ্য অধিকৃত স্থানগুলো হল আধুনিক: গণচীন, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, মলদোভা, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং কুয়েত। চেঙ্গিজ খান মারা যাওয়ার পর তার পুত্র ও পৌত্রগণ প্রায় ১৫০ বছর ধরে মঙ্গোল সম্রাজ্যে রাজত্ব করেছিল। তিনি ছিলেন ১৩শ শতকের সবচে প্রভাবশালী ব্যক্তি।

ইবনে খালদুনঃ ১৪শ শতকের প্রখ্যাত ইবনে খালদুন (Ibne Khaldun) ছিলেন একজন আরব মুসলিম পন্ডিত। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও অর্থনীতির জনকদের মধ্যে তাকে অন্যতম বিবেচনা করা হয়। তাঁর বিখ্যাত বই ”মুকাদ্দিমা” এর জন্য তিনি অধিক পরিচিত। তিনি মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম হিসেবে গণ্য।

তৈমুর লংঃ ১৫শ শতকের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং (Tamerlane)। তিনি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজ দখলে এনে তৈমুরীয় সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ যার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত। তিনি একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করিয়ে যান যার নাম তুজুক ই তৈমুরী।

ম্যাকিয়াভেলিঃ ম্যাকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli) ছিলেন রেনেসাঁ বা ইউরোপীয় নবজাগরণ যুগের একজন রাজনৈতিক দার্শনিক, সঙ্গীতকার, কবি এবং নাট্যকার। ১৬শ শতকে তাঁর ধ্যান-ধারণা ছিলো ইতালীয় রেনেসাঁর অন্যতম পাথেয় এবং রেনেসাঁকালীন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মূল তত্ত্ব। তাঁর এ ধারণাকে বলা হতো ‘ম্যাকিয়াভেলিজম’। তাঁর সবচে বিখ্যাত গ্রন্থের নাম The Prince। কথিত আছে, মুসোলিনি এ বইয়ের একটি সংস্করণে ভূমিকা লিখেছিলেন। হিটলার তাঁর শয্যাপাশে সবসময় এক খণ্ড দ্য প্রিন্স রাখতেন বলে শোনা যায়। 

মার্টিন লুথারঃ খ্রিস্টধর্মের প্রটেসট্যানিজম (Protestantism) ধারার জনক মার্টিন লুথার (Martin Luther) ছিলেন একজন জার্মান ধর্মযাজক এবং ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক। তিনি ষোড়শ শতকে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মবিপ্লবের সূত্রপাত করেন। পাপ করে অর্থের বিনিময়ে বিধাতার শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় – এই মতের তিনি কঠোর বিরোধিতা করেন। ১৭শ শতকের পুরাটাই তাঁর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিল যা এখনও বিদ্যমান। 

নিউটনঃ ১৮শ শতকের স্যার আইজ্যাক নিউটন (Sir Isaac Newton) ছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক এবং আলকেমিস্ট। অনেকের মতে, নিউটন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। ১৬৮৭ সনে তার বিশ্ব নন্দিত গ্রন্থ ফিলসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা প্রকাশিত হয় যাতে তিনি সর্বজনীন মহাকর্ষ এবং গতির তিনটি সূত্র বিধৃত করেছিলেন। এই সূত্র ও মৌল নীতিগুলোই চিরায়ত বলবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, আর তার গবেষণার ফলে উদ্ভূত এই চিরায়ত বলবিজ্ঞান পরবর্তী তিন শতক জুড়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার জগতে একক আধিপত্য করেছে।

ডারউইনঃ ১৯ শতকের জীববিজ্ঞানী ডারউইন (Charles Darwin) সেই থেকে আজ অবধি তাঁর বিতর্কিত বিবর্তনবাদের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার জীবদ্দশাতেই বিবর্তনবাদ একটি তত্ত্ব হিসাবে বিজ্ঞানী সমাজ ও অধিকাংশ সাধারণ মানুষের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে।

আইনস্টাইনঃ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং বিশেষত ভর-শক্তি সমতুল্যতার সূত্র আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আইস্টাইন (Albert Einstein) ছিলেন বিংশ শতকের সবচে প্রভাবশালী ব্যক্তি। ১৯৯৯ সালে টাইম সাময়িকী আইনস্টাইনকে “শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি” হিসেবে ঘোষণা করে।

[বিঃদ্রঃ- শতকের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচনের বিষয়টি লেখকের একান্ত নিজস্ব ধ্যান-ধারণাপ্রসূত। এ ক্ষেত্রে সবারই ভিন্ন মতামত থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং, সকল পাঠকের ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে]

প্রথম প্রকাশকাল- ২৯ মার্চ ২০২০

সম্পর্কিত অন্যান্য ব্লগ