সাপ নিয়ে যত কল্পকথা
বেচারা সাপ! জন্মের পর থেকেই রূপকথা, উপকথা আর পৌরাণিক কাহিনীর হাতে বন্দি। বন্ধুত্বে সাপ আবার শত্রুতায় সাপ, ধর্মে সাপ আবার অধর্মেও সাপ- হলিউড থেকে ঢালিউড, কী প্রাচীন আর কী আধুনিক, সর্বকালের কল্প-কাহিনীতে সাপের অস্তিত্ত্ব রয়েছে। ইসলাম ধর্মে সাপের মুখে করে ইবলিশ বেহেশতে প্রবেশ করে, সনাতনে মাথায় সাপ পেঁচিয়ে বসে থাকেন শিব, পুরাণ মতে যার কন্যা স্বয়ং লৌকিক সর্পদেবী- মা মনসা। মিশরীয় দেবতাদের শিরস্ত্রাণে সাপেদের অবস্থান, গ্রিক পুরাণে ‘মেডুসা’ ছিলো একজন ভয়ংকর দানবী যার মুখমন্ডল ছিলো নারীর কিন্তু মাথায় কেশের পরিবর্তে জীবন্ত সাপে পূর্ণ ছিলো।
‘সাপ যেন কাল থেকে কালান্তরে , স্বর্গ থেকে মর্তে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে স্বীয় রাজ্য কায়েম করেছে।’ বেহুলার কাল নাগিনী, উড়ন্ত পঙ্খিরাজ, নিঃশ্বাসের সাথে মানুষ গিলে ফেলা অতিকায় অজগর, মণিওয়ালা সাপ, ইচ্ছাধারী নাগিন, চাইনিজ ড্রাগন আরো কত কী! সাপের সাথে সাথে বাবুরাম সাপুড়েও কাহিনীতে ঢুকে পড়ে, বীণ বাজিয়ে সাপের নাচ দেখাতে থাকে। সাপের কী পোড়া কপাল! কান না থাকলেও বীণের সুর শোনার ভান করে তাকে আবার নাচতেও হয়। সত্যিকথা বলতে প্রাণিকূলের মধ্যে সাপের মতো আর কোন প্রাণি কখনো এত বেশী রূপালি পর্দা কাঁপাতে পারেনি। বিশ্বাসটা এ অব্দি পৌঁছেছে যে ঐ সকল সেলুলয়েডের সাপকাহন যে নিছকই ভাওতাবাজি তা অনেক শিক্ষিত লোক আজও পুরোপুরি মানতে নারাজ।
সেলুলয়েডের সাপকাহন থেকে বাস্তবে ফিরে দেখি এখানেও সাপ নিয়ে মুখরোচক, চাঞ্চল্যকর ও রগরগে শিরোনামে খবরের অভাব নেই। ‘যশোরে সাপ মেরে বিপাকে একটি পরিবার’- অভয়নগর উপজেলার গাজীপুর গ্রামের মোকাদ্দেস মোল্লার ছেলে তরিকুল মোল্লা জানান, সকালে বাড়ির প্রাচীরের ওপর একটি সাপ দেখতে পেয়ে তিনি সাপটি পিটিয়ে মেরে ফেলেন। তারপর আধা ঘণ্টার মধ্যেই গোটা বাড়িতে ২০-২৫টি সাপ জড়ো হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তরিকুল মোল্লা পরিবারের সবাইকে নিয়ে আতঙ্কে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েন। (প্রকাশকাল ০৭ মে ২০১৫)
‘তরুণীর কবরে জলজ্যান্ত ভয়ংকর বিষধর সাপ…!’ – পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে পাকিস্তানে এক মহিলার মৃত্যু হয়। জানাযার পর তার লাশ যখন কবরে রাখার জন্য খাটিয়া থেকে নীচে নামানো হয় তখন দেখা যায় কবরের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর সাপ!… অতঃপর ঐ মহিলার জন্য দ্বিতীয় আরেকটি কবর খোড়া হয়।… কিন্তু যখনই তারা লাশ কবরে রাখতে গেল তখনই দেখা গেল উহার মধ্যেও সেই সাপ যা প্রথম কবরে ছিল। এরপর তৃতীয় কবর খোড়া হলো। তাতেও লাশ রাখার সময় প্রথম কবরের সেই সাপটি দৃশ্যমান হলো (প্রকাশকাল ২১ জানুয়ারি ২০১৫, ভিডিও লিঙ্ক)।
‘গোপালগঞ্জে সাপ প্রসব নিয়ে তোলপাড়’- গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মানিকহার গ্রামের শিশির কান্তি দাস রিপন দাবী করেছিলেন যে তিনি মলদ্বার দিয়ে একটি সাপ প্রসব করেছেন। দুই সন্তানের জনক শিশির ছিলেন মানিকহার গ্রামের দুর্গা ও মনসা মন্দিরের সেবক। তাঁর দাবী ছিল সে স্বপ্নে দেখেছে যে তাঁর গর্ভে সন্তান আছে এবং দৈব কারণে তাঁর পেটে সাপ জন্ম নিয়েছে (প্রকাশকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। ‘যশোরে রোগমুক্তির জন্য সাপ পালন!’- রোগমুক্তির জন্য ১১টি বিষধর সাপের বাচ্চা লালন পালন শুরু করেছেন যশোর সদর উপজেলার দোগাছিয়া গ্রামের আতিয়ার গাজীর মেয়ে পারুল বেগম। স্বপ্নের বর্ণনা মতে তথাকথিত কোন এক বটতলার সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বয়োবৃদ্ধ তাকে এ সাপগুলো পালনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দিনের অধিকাংশ সময় পারুল বেগম তার সাপের বাচ্চাগুলো নিয়ে সেখানে দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করেছিলেন। (প্রকাশকাল জুলাই ২০১২)
এ সকল সংবাদের কয়েকটি এজমালি বৈশিষ্ট্য থাকে। এরা মূলত স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, দু’একদিন ধর্মভিত্তিক আলোচনার কেন্দ্রে থাকে, তারপর কালের অতলে হারিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে কোন ফলো-আপ প্রতিবেদন আর প্রকাশ হয় না। এ সব সংবাদ একসঙ্গে কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও সংবাদের বিষয়বস্তু, তথ্যের বিবরণ, ঘটনা প্রবাহ ইত্যাদি হুবহু একই রকম থাকে এবং ঘটনার বিবরণের মধ্যেই ঘটনার সত্যতায় দুর্বলতা থাকে। যেমন, গাজীপুর গ্রামের ঘটনায় বলা হয়েছে একটি সাপ হত্যার আধা ঘণ্টা পর তরিকুল মোল্লার গোটা বাড়িতে ২০-২৫টি সাপ জড়ো হয়েছে। ঘটনাটায় সাপ না থেকে কাক থাকলেও বিশ্বাস করতাম কারণ কাক যূথচারী পাখি, দলবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করে।
কোন কাক মরে পড়ে থাকলে আশেপাশের উড়ন্ত অন্য কাকেরা সেখানে জড়ো হয়। আপনি কাক মেরে নির্জন স্থানে ফেলে রাখলে কোন কাক আসবে না, অর্থাৎ, মৃত কাকের কোন টেলিপ্যাথিটিক ক্ষমতা নেই। সাপের কোন টেলিপ্যাথিটিক ক্ষমতা নেই এবং সাপ যূথচারীও নয়, বরং ক্ষুধায় সাপ তার নিজের বাচ্চা পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। একটি সাপ মারা যাবার মাত্র আধা-ঘণ্টার মধ্যে সেখানে ২০-২৫টি সাপ হাজির হবার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। ঘটনাটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তরিকুল মোল্লা কিছু সাপ কিনে এনে সেটা বাড়িতে, উঠোনে ছেড়ে দিয়ে মোবাইলে ভিডিও করে দিলে মন্দ হতো না।
তরুণীর কবরে বিষধর সাপের সংবাদটিও ত্রুটিপূর্ণ। ঘটনার সেট পাকিস্থানে হলেও ভিডিও চিত্রের কাউকেই পাকিস্থানি বলে ঠাওর হয় না। আবার ঘটনার বর্ণনায় একটি সাপের কথা বলা হলেও ভিডিওটিতে একাধিক সাপের আবির্ভাব হয়েছে। যদি ঘটনার সময়কাল ২৫-৩০ বছর আগে হয়, তবে সে সময় ভিডিও ক্যাপচারের ক্ষমতাসম্পন্ন মোবাইল পাকিস্তানিদের হাতে হাতে ছিল একথা আমাকে বিশ্বাস করানো কঠিন। যদি বলা হয় ভিডিও ক্যামেরায় এটি ধারণ করা হয়েছিল, তবে মনে রাখতে হবে এটি কোন রাষ্ট্রীয় দাফন নয় আর তাই ঐ লাশ দাফনের সময় ভিডিও ক্যামেরার উপস্থিতির যৌক্তিকতা কোনভাবেই হালে পানি পাবে না।
মনসা মন্দির সেবকের মলদ্বার দিয়ে সাপ প্রসব- এ সংবাদ তো গাঁজাকেও হার মানায়। শিশির যখন নিজেকে অন্তঃসত্ত্বা বলে দাবী করেছিলেন তখন ক্লিনিকে নিয়ে তার প্রেগন্যান্সিও টেস্ট করা হয়েছিল- নেগেটিভ। পরে আল্ট্রাসনো করেও প্রেগন্যান্সির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপরেও তিনি অজগরই প্রসব করলেন! এ ঘটনার সত্যতা বিশ্লেষণেরও অযোগ্য।
এবার স্বপ্নদ্রষ্টা পারুল বেগমের ঘটনায় আসি। এ সংবাদের দুর্বলতম দিক বটতলার ঐ সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত বয়োবৃদ্ধ, এক্কেবারে রূপালি পর্দায় ফস্ করে হাজির হওয়া দরবেশের মতো। অন্তর্ধানের ক্ষমতা সম্পন্ন এমন দরবেশের পেছনে ঠাকুরমার ঝুলি, আলিফ লায়লা, সিন্দাবাদ ইত্যাদির যে বেশ ভালো প্রভাব রয়েছে তা স্পষ্টতই চোখে পড়ে। সম্ভবত তিনি কোনভাবে সাপের বাচ্চাগুলো যোগাড় করেন এবং সেই সাথে কাহিনীটিও।
ধর্মীয় প্ররোচনা ও প্রণোদনা ছাড়াও এ সকল রটনার পিছনে সবসময়ই একটি উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হলো ব্যবসা। সাপাশ্রিত মাদুলি ব্যবসা, টোটকা চিকিৎসা। ‘স্বপ্নে পাওয়া চিকিৎসা’ আমাদের দেশে নতুন নয়। এ স্বপ্ন, স্বপ্নে পাওয়া মাদুলি, কবচগুলো একচেটিয়াভাবে সমাজের অশিক্ষিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মেধাস্বত্ত্ব আইনে বন্দি। কোন শিক্ষিত আধুনিক মানুষ এ সকল স্বপ্ন দেখেন না, বোধহয় তাদের দেখার অধিকারও নেই। এ সকল রটনা, ব্যবসা যারা বোঝে তারা সাপের ব্যাপারে, সাপুড়ের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ভয় পায়, আর যারা বোঝে না তারা বশীকরণ মাদুলি, শিকড়-বাকড়, ষণ্ডার তেল, ধনন্তরী বড়ি ইত্যাদি কিনে বাড়ি ফেরেন।
‘কী সাপে দংশিল লখাইরে…ও বিধির কি হইল।…খা খা খা তোর বক্ষিলারে খা… এই থাম থাম, আস্তে, আস্তে।’
প্রথম প্রকাশকাল– ১০ মে ২০১৫