রামায়ণ মহাকাব্যের চরিত্র চিত্রণ

রামায়ণ মহাকাব্য এক অসাধারণ সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে ও ভাষায় রামায়ণ মহাকাব্যের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাংলা ভাষার অমৃত সূধা পান করতে হলে রামায়ণ-এর মতো মহাকাব্য গুলোর চরিত্র ও ঘটনাবলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন।

রামায়ণ মহাকাব্যের কিছু চরিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে। তবে এ মহাকাব্যের অনেক চরিত্র সম্পর্কে আমাদের তেমন ধারণা নেই। হিন্দু পুরাণের বিশালতা, তথ্যের জটিলতা ও অস্পষ্টতার কারণে রামায়ণ-এর মতো মহাকাব্য আমাদের জন্য সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে না। রামায়ণ-কে সহজপাঠ্য করে তুলতে এ মহাকাব্যের চরিত্রগুলোকে সহজ ও বোধগম্য করে তুলে ধরা হলো।

হিন্দু পুরাণগুলোতে দুটি শুক্তিশালী রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়- সূর্য বংশ ও চন্দ্র বংশ। সূর্য বংশকে ঘিরে রামায়ণের চরিত্রাবিধান তৈরী হয়েছে। তাই এ মহাকাব্যের চরিত্রগুলো বোঝার জন্য সূর্য বংশ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।  

হিন্দুধর্মের তিন প্রধান দেবতা-ব্রহ্মা, বিষ্ণুশিব। ব্রহ্মা সৃষ্টি, বিষ্ণু লালন ও শিব প্রলয়ের দেবতা। শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কর্তা- পরমেশ্বর (বা মহেশ্বর) হিসেবেও স্বীকৃত। এই তিন দেবতাকে- ব্রহ্মা (পৃথিবী)  সৃষ্টি, বিষ্ণু (জল) লালন ও শিব (আগুন)- এক সঙ্গে ত্রিমূর্তি বলে।

ব্রহ্মার মানস সন্তান (মানসপুত্র, মানসকন্যা)  ছিল।  মানসপুত্ররা প্রজাপতি (বা ঋষি, মহর্ষি, মহামুনি ) নামে পরিচিত। এই সন্তানগণ তার শরীর থেকে সৃষ্টি হয়নি, মন থেকে সুষ্টি হয়েছে। এই কারণে এদেরকে মানসপুত্র বা মানসকন্যা বলা হয়। ব্রহ্মার ঠিক কতজন মানস সন্তান ছিল তা বলা মুশকিল। সচরাচর যে সকল মানসপুত্রের নাম নাম পাওয়া যায় তারা হলো- সপ্তর্ষি (মরীচি, অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ), দক্ষ, ভৃগু, নারদ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, কশ্যপ, পর্বত ইত্যাদি। এই প্রজাপতিরাই মানবজাতির আদিপিতা। এরা ব্রহ্মাকে পৃথিবী সৃষ্টির কাজে সহায়তা করেছিলো।

দক্ষ তার কন্যাদেরকে (অদিতি, দিতি, বিনতা ইত্যাদি) কশ্যপকে সমর্পণ করেছিলো। এর মধ্যে এক কন্যা  অদিতির গর্ভে দেবতা, আরেক কন্যা দিতির গর্ভে দানবদের জন্ম হয়।হিন্দুশাস্ত্রে রাক্ষস বা অসুর, রাক্ষস ও দানব ভিন্ন। রাক্ষস ও দানবদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিলো না। অদিতির গর্ভের দেবতারা আদিত্য (সূর্য দেবতা) নামে পরিচিত। এদের সংখ্যা বারো (মতান্তরে ৭ বা ৮) জন বলে এদেরকে একত্রে দ্বাদশ আদিত্য বলে। এই দ্বাদশ আদিত্যের এক জনের নাম বিবস্বান।   

বিবস্বানের পুত্রের নাম বৈবস্বত মনু। সে ছিল মহামুনি। বৈবস্বত মুনির পুত্রের নাম ইক্ষ্বাকু (ইক্ষবাকু)। তিনি ইক্ষবাকু রাজবংশ তথা সূর্যবংশের প্রথম রাজা। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশে অযোধ্যা শহরকে কেন্দ্র করে কোশাল রাজ্য (খ্রি.পূ ৭০০-৫০০) গড়ে তুলে ছিলেন। তার শত পুত্র ছিল। এদের এক জনের নাম ছিল নিমি। সে ছিল মিথিলা (Kingdom of Videha) রাজ্যের রাজা।

সূর্যবংশীয় রাজাদের বংশ পরম্পরায় কোশাল রাজ্য শাসন চলতে থাকে। এদের এক জনের নাম ছিল দিলীপ। দিলীপের পুত্র রঘু, রঘুর পুত্র অজ ও অজের পুত্র দশরথ। অন্যদিকে, নিমির বংশ পরম্পরায় মিথিলার শাসনে যে রাজা আসে তার নাম জনক।  কোশাল রাজ্যের অযোধ্যায় রাজা দশরথের ঘরে রাম আর মিথিলায় রাজা জনকের ঘরে সীতার জন্ম হয়েছিল। রাম ও সীতা রামায়ণ মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র।

কৌশল্যাকৈকেয়ী ও সুমিত্রা রাজা দশরথের তিন স্ত্রী। কিন্তু তাদের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। পুত্র সন্তানের জন্য সে এক যজ্ঞের আয়োজন করে। যজ্ঞের পায়েস সে দুই ভাগ করে কৌশল্যাকৈকেয়ীকে দেয়। এরা দুজন মিলে তাদের পায়েসের অংশ সুমিত্রাকে দেয়। কৌশল্যার গর্ভে এক পুত্র রাম (জ্যেষ্ঠপুত্র), কৈকেয়ীর গর্ভে এক পুত্র ভরত এবং সুমিত্রার গর্ভে দুই পুত্র  লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন (যমজ) মোট চার সন্তানের জন্ম হয়। সীতা রামের স্ত্রী এবং রাম ও লক্ষণ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা।

রামায়ণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মন্থরামন্থরা রাণী কৈকেয়ীর কূটবুদ্ধি সম্পন্না কুঁজো দাসী।  রাজা দশরথের শম্বরাসুরের সাথে যুদ্ধ করেছিলো। এ যুদ্ধে সে আহত হয়। এ সময় মন্থরা দশরথকে সেবা করে সুস্থ করে তোলে। এ জন্য দশরথ কৈকেয়ীকে দুটি বর (ইচ্ছাপূরণ) দিতে চেয়েছিল। যখন রামের রাজ্যাভিষেকের আয়োজন চলছিল, তখন মন্থরার পরামর্শে কৈকেয়ী সেই দুটি বর চায়। একটি ভরতকে রাজ্যে অভিষিক্ত করা এবং দ্বিতীয়টি রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনে পাঠানো। সত্য রক্ষার জন্য দশরথ এই বর দিতে বাধ্য হয়। রামের বনবাসের ষষ্ঠ দিন দশরথ পুত্রশোকে মারা যায় ।

রাম  হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। হিন্দু ধর্মালম্বীরা বিষ্ণুর দশাবতারে (মতান্তরে বাইশ) বিশ্বাস করে। অবতার হলো কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে দেবতাদের মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ। বিষ্ণু এ যাবৎ নয় বার অবতার রূপে এসেছে। এ রূপ গুলো হলো-  মৎস্য (মাছ), কূর্ম (কচ্ছপ), বরাহ (বন্য শূকর), নৃসিংহ (অর্ধ মানুষ অর্ধেক সিংহ), বামন (খর্বকায় মানুষ), পরশুরাম (পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রাম), রাম (অযোধ্যার যুবরাজ), বলরাম (শ্রীকৃষ্ণের ভ্রাতা) ও গৌতম বুদ্ধ (বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা)। (মতান্তরে, শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম ও তার ভাই বলরাম নবম অবতার)। কল্কি হিসেবে ভবিষ্যতে বিষ্ণুর অবতারণা হবে বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে।

রামের দুই যমজ পুত্রের নাম লব ও কুশ। সীতার দ্বিতীয়বার বনবাস কালে এদের জন্ম হয়। রামের সাথে লব ও কুশের একবার যুদ্ধ হয়েছিল। এ যুদ্ধে রাম পরাজিত হয়।

দেবতা ইন্দ্র ব্রহ্মার এক মানস কন্যা অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিল। রামের পা স্পর্শ করে এই অহল্যার শাপমোচন হয়েছিল।

রামের মতো সীতাও এক অবতার। সে দেবতা বিষ্ণুর স্ত্রী ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর অবতার। সীতার জন্ম একটু অস্বাভাবিক। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জমি চাষ করার সময় লাঙলের আঘাতে ভূমি বিদীর্ণ করে সীতার জন্ম হয়। সীতা চরিত্রের মূল লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সীতার সতীত্ব বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে, দুই বার বনবাসে যেতে হয়েছে, এবং অবশেষে লজ্জা ও ক্ষোভে  জগদ্ধাত্রীর সহায়তায় তাকে পাতালে প্রবেশ করতে হয়েছে।

রামায়ণের কয়েকটি সংকলনে মায়া সীতা বা ছায়া সীতা নামে একটি চরিত্রের অবতারণা করা হয়েছে। রাবণ আসল সীতার স্থলে তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। আরো মনে করা হয়, সীতা পূর্বজন্মে বেদবতী ছিলেন, যাকে রাবণ উৎপীড়ন করার চেষ্টা করেছিল। পরজন্মে সীতা দ্রৌপদী বা দেবী পদ্মাবতী রূপে পুনর্জন্ম লাভ করে।

রামের ভাই লক্ষ্মণকে শেষনাগের অবতার মনে করা হয়।। কশ্যপ মুনির ঔরসে কদ্রুর গর্ভে জন্ম নেয়া সাপ শেষনাগ। এর অন্য নাম বাসুকি বা অনন্তনাগ।  দেবতা শিবের গলায় যে সাপটি পেঁচানো থাকে এটাই শেষনাগ। এর বোনের নাম মনসা  (এ সর্প দেবী শিবের কন্যা হিসেবেও পরিচিত। অন্যনাম নিত্যা, পদ্মাবতী ইত্যাদি)। লঙ্কার যুদ্ধে লক্ষণ রাবণের পুত্র মেঘনাদকে বধ করেন।  লক্ষ্মণ সীতার ছোট বোন উর্মিলাকে বিবাহ করেছিলেন। তার দুই পুত্রের নাম ছিল অঙ্গদ ও চন্দ্রকেতু। বর্তমান উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানী লক্ষ্ণৌ শহরটি সে প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

রামের আরেক ভাই ভরত। রাম বনবাসে থাকা কালে ভরত অযোধ্যার রাজা ছিলো। যত দিন রাম বনবাসে ছিল, ভরত রামের খড়মকে সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করে। রামের প্রত্যাবর্তনের পর সে রামকে রাজ্য ফিরিয়ে দেয়। ভরত সীতার চাচাতো বোন (কুশধ্বজের কন্যা) মাণ্ডবীকে বিয়ে বরে। তক্ষ ও পুষ্কল নামে তাদের দুই পুত্র।  

লক্ষণের ছোট ভাই শত্রুঘ্ন। সে কুশধ্বজের কন্যা শ্রুতকীর্তিকে বিয়ে করে। তাদের পুত্র সুবাহু ও শত্রুঘাতী। শত্রুঘ্ন মথুরা রাজ্যের মধুদৈত্যের পুত্র লবণাসুরকে হত্যা করে।

কৌশল্যার গর্ভে দশরথের কন্যা রামের বড় বোন শান্তা। দশরথের ভায়রা অঙ্গরাজ (বঙ্গদেশ) রোমপাদ শান্তাকে দত্তক নিয়েছিল। শান্তা ঋষ্যশৃঙ্গকে বিয়ে করেছিল। ঋষ্যশৃঙ্গের হরিণের মতো শিং ছিলো। সে দশরথের পুত্র সন্তানের জন্য যজ্ঞের আয়োজন করে।  

রামায়ণের একচি ছোট চরিত্র অন্ধ ঋষিদ্বয় শান্তনু এবং মলয়ার পুত্র শ্রবণ কুমার। সে নিষ্ঠার সঙ্গে অন্ধ মা-বাবার সেবা করতো। শ্রবণ নিজে মা-বাবাকে একটি ভারে তুলে এদিকে সেদিকে নিয়ে যেতেন। একদিন রাজা দশরথ শিকারের উদ্দেশ্যে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। শ্রবণ বাবা-মার জন্য নদীতে জল আনতে গিয়েছিল। পানিতে শব্দ শুনে সেখানে তীর মারে দশরথ, মারা যায় শ্রবণ কুমার। শ্রবণের মা-বাবা দশরথকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলো যে, তারও পুত্রশোকে মৃত্যু হবে।

রামায়ণে উল্লিখিত স্থানসমূহের মধ্যে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ- কোশাল, মিথিলা, অঙ্গদেশ, দণ্ডকারণ্য, কিষ্কিন্ধা ও লঙ্কা। কোশাল, মিথিলা ও অঙ্গদেশের কথা উপরে বলা হয়েছে। বাকী স্থানগুলোর একটি দণ্ডকারণ্য বিশাল এক অরণ্যময় অঞ্চল ভারতের বর্তমান মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র এই চারটি রাজ্য ব্যাপী বিস্তৃত। এখানে রামের সাথে সুগ্রীবের দেখা হয়। কিষ্কিন্ধা ছিল বানরদের রাজ্য। ভারতের বর্তমান কর্নাটক প্রদেশের বেল্লার জেলা সংলগ্ন অঞ্চলে এ রাজ্য ছিল। আর লঙ্কা কথা তো আমরা সবাই জানি, এটি শ্রীলংকা।

রামায়ণ মানচিত্র