বর্ণবাদ নিয়ে মাঝে মধ্যেই শোরগোল হয়। কয়েকদিন আগে আমেরিকার মিনিসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে ড্রেক শোয়িনসহ কয়েকজন শেতাঙ্গ পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে প্রায় নয় মিনিট ধরে হাঁটুর নিচে চেপে রেখেছিল। ফলে মৃত্যু তার হয়। ঘটনাটি নিয়ে আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’শ্লোগানে সামাজিক আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ আন্দোলন উত্তাপ ছড়িয়েছে।
ইউরোপ, আমেরিকার মতো বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবী করলেও বর্ণবাদকে কেউ রোধ করতে পারেনি। পৃথিবীর কোন দেশের কোন আইন বর্ণবাদকে সমর্থন করে না। তবুও বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে বর্ণবাদ ছিল, আছে এবং থাকবে। কারণ বর্ণবাদ একটি অপসংস্কৃতি। এর অস্তিত্ত্ব আছে আমাদের মস্তিস্কে, লালন হচ্ছে আমাদের মানসিকতায় আর প্রকাশ পাচ্ছে আমাদের আচরণে।
ইউরোপ, আমেরিকার বর্ণবাদী ঘটনা নিয়ে বাঙালির নাক সিটকানোর সুযোগ নেই। আমরা নিজেরা যে বর্ণবাদকে লালন-পালন করছি তা বিশ্বের অন্য যেকোন দেশের থেকে কম নয়। আমাদের বর্ণবাদ ‘সুন্দর, ভালো, পবিত্র’ শব্দসমূহের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে সহজে বোঝা যায় না। তবে একটু খুঁজলে পাওয়া যায়।
আমার একটি অভ্যেস হলো লাল চালের ভাত খাওয়া। বাজারে গিয়ে লাল চাল আছে কি না জিজ্ঞেস করলে দোকানি যেন কেমন ভাবে তাকায়। ভাবখানা এমন যেন আমি কোন অন্যায় করেছি। ভদ্রলোকের পোশাক পরা কোন লোক এ চাল খায় সেটি যেন দোকানদারেরা বিশ্বাস করতে চায় না।
মাঝে মধ্যে দু’এক জন আবার সাহস করে জিজ্ঞেস করে, “কার জন্য?” বলি “আমার জন্য”। উত্তরে ভ্রু দু’টি বাঁকা উপরে তুলে রাখে। কেউ কেউ বলে, “গরীব মাইনসেও অহন আর লাল চাইল খায় না।” কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, “দ্যাখতে সুন্দর না”।
মিনিকেট নামে কোন ধান না থাকলে বাজারে মিনিকেট চাল আছে। মিনিকেট হলো কেটে মিনি বা ছোট করা চাল। মিনিকেট হলো স্লিম ও জিরো ফিগারের চাল। এছাড়া, বহুল ব্যবহৃত আরেকটি সুন্দর চাল হলো নাজিরশাইল। এটিও স্লিম। দুটি চালের বিশেষ গুণ হলো এরা ফর্সা ও স্লিম। এদের ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ মাখানো ফর্সা দেহ আছে। এদের তুলনায় লাল চাল দেখতে শ্যামলা ও মোটা, স্থুল কালো দেহ।
সাদা ও স্লিম করার জন্য মিনিকেটকে যেভাবে ছাঁটা হয়, নাজিরশাইলকে কিভাবে ইউরিয়া দিয়ে ধোয়া হয় তা আমাদের সবার জানা। এদের থেকে লাল চালের পুষ্টি গুণ অনেক বেশী সেটাও সবাই মানে। তবুও লোকে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের চেয়ে লাল চাল কম খায় কারন ওরা ফর্সা নয়, লালচে।
বাঙালি সিগারেটের বেলায়ও বর্ণবাদী। লাল ফিল্টারের সিগারেটের চেয়ে ঝকঝকে তকতকে সাদা (ফর্সা) কাগজ ও ফিল্টারের সিগারেটের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। এ জন্য সিগারেট তৈরির কোম্পানিগুলো লাল ফিল্টারের পাশাপাশি সাদা ফিল্টারের সিগারেট বানায় এবং ফর্সা রঙ দেখিয়ে দাম একটু বাড়িয়ে নেয়। সাদা বা ফর্সা ব্যাপারটা আমাদের মনোজগতের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, আমরা আমাদের অজান্তেই বর্ণবাদী আচরণ করি।
সাদা ও কালো রঙের পোশাকের মধ্যেও আমাদের বর্ণবাদ লুকিয়ে থাকে। আমাদের দেশীয় সিনেমায় সুফি-দরবেশকে এখনও সাদা পোশাকে আর দৈত্য-দানব, দুষ্টু লোককে কালো পোশাকে দেখা যায়। নায়করা ফর্সা, ভিলেনরা কালো। নায়িকাদের দেহের যতটুকু ক্যামেরায় দেখানো হয় ততটুকুতেই সাদা পাউডারের ঘন গাড়ো প্রলেপ থাকে। বিউটি পার্লারে গিয়ে সবাই রঙ মেখে সঙ সেজে ফর্সা হতে চায়। মুখ-হাতে কয়েক দফা প্লাস্টার করে নিজেকে সবাই ফর্সা করে তোলার চেষ্টা করে। ধনে আর বলে কম হলেও শত শত নারী আফ্রিদিকে‘ম্যারি মি’ প্লাকার্ড দেখায়, ক্রিস গেইলকে দেখায় না।
বছরের পর বছর বাংলাদেশে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের রমরমা ব্যবসা চলছে। ক্রিম মেখে কেউ ফর্সা হয় না জেনেও সবাই সেটা মাখছে। এ সব ক্রিমগুলো সাদা রঙের করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, রঙ ফর্সাকারী ক্রিম যদি সাদা না হতো, তবে হয়তো এটার ব্যবহারও কমে যেত।
দোকান, শো-রুমে বিক্রেতা, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, কোচিং সেন্টারের অভ্যর্থনাকারী সবখানেই ফর্সাদের আধিপত্য। এখানে যোগ্যতার চেয়ে চামড়ার রঙের মূল্য বেশি। চামড়া দেখে এখানে যাদের নিয়োগ করা হয়, তারাও জানে তাদেরকে পণ্য হিসেবে হাটে তোলা হচ্ছে। কেউ হয়তো এটা উপভোগ করে, হয়তো বা কেউ করে না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা মনে করে ফর্সা মুখ, ফর্সা দেহ দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করতে, লোক ঠকাতে সুবিধা হবে। বাস্তবতাও তাই। ক্রেতারা, খদ্দেররা এদেরকে উপভোগ করে, চোখ দিয়ে মজা লুটে নেয়, নাক দিয়ে ফর্সা চামড়ার গন্ধ টেনে উপভোগ করে। ফর্সাদের প্রতি আমাদের আজন্ম দূর্বলতা আছে।
শুধু মানুষ কেন, দেব-দেবীরাও বর্ণবাদের শিকার। যেখানে যত দেব-দেবীর ছবি দেখবেন সবাই ফর্সা রঙের। ঝামেলা হয়েছে মহাদেব শিব, শ্রীকৃষ্ণ ও দেবী কালীকে নিয়ে। পৌরাণিকভাবে এদের ফর্সা রঙের অবয়ব তৈরি সম্ভব নয়। কিন্তু বর্ণবাদ এদেরকেও ছাড়েনি। তাই এরা এখন আগের মতো কালো নেই, সময়ের বিবর্তনে গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করেছে।
রঙের সাথে সৌন্দর্যের সম্পর্ক টানা বাঙালির জন্মগত বিশ্বাস। আমরা যেভাবে, যা দেখে শুনে বেড়ে উঠেছি, সেভাবে তা ভাবতে শিখেছি। এভাবে জন্মলগ্ন থেকে আমরা সবাই ধীরে ধীরে বর্ণবাদী হিসেবে গড়ে উঠছি।
জিম্বাবুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে বলেছিল, যতদিন সাদা গাড়িতে কালো টায়ার ব্যবহার করা হবে, ততদিন বর্ণবাদ থাকবে। যতদিন সাদাকে শান্তির রং আর কালোকে শোকের রং বলা হবে, ততদিন বর্ণবাদ থাকবে। যতদিন মানুষ বিয়েতে সাদা আর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কালো রঙের জামা পরবে, ততদিন বর্ণবাদ থাকবে।
মুগাবের সাথে আমিও একমত। বর্ণবাদ অনন্তকাল টিকে থাকবে। তবে তাঁর ঐ কথাটুকুর শেষাংশও আমি বিশ্বাস করি: তবে আমার কোন আপত্তি নেই, যতদিন আমার কালো নিতম্ব মুছতে আমি সাদা টয়লেট পেপার ব্যবহার করছি, ততদিন আমি খুশি (But I don’t care, as long as I’m still using white toilet paper to wipe my black ass, I’m happy.)।
সম্পর্কিত অন্যান্য ব্লগ
- কারোলি তাকাকসঃ স্বপ্নের হাতে অঙ্গীকারের ট্রিগার
- টিভি চ্যানেল দেশি কিন্তু বিজ্ঞাপন বিদেশি
- বিজ্ঞাপনী SMS ও ফোনকল
- ভূত রহস্য
- কী সাপ দংশিল লখাইরে!
- পৃথিবীর বিষাক্ততম প্রাণি
- আমাজন জঙ্গলে চারটি দিন
- সোফিয়া ও বারাক ওবামা!
- BCS এখন এক নেশার নাম