বাঙালি ধর্মপ্রাণ জাতি এবং বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। আমাদের মহান সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন”৷ ৪১ (ধর্মীয় স্বাধীনতা) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে – “(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে; (২) কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না”। 

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ১২ অনুচ্ছেদ ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে ৷ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে৷”

সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’-র ব্যাপারে বলা হয়েছে, “ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য – (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে৷”

শত-সহস্র বছর ধরে বাংলার মানুষের মনে প্রাণে ধর্ম লালিত হচ্ছে। ৮ম শতকে নির্মিত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (সোমপুর বিহার), ১৩দশ শতকের ঢাকেশ্বরী মন্দির, ১৫দশ শতকের বাবা আদম মসজিদ ও ১৭দশ শতকের আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারিও ক্যাথিড্রাল চার্চ আজও এ অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বাক্ষী বহন করছে। তাই এখনও এদেশে এক আঙিনায় অবস্থিত মসজিদ ও মন্দির রয়েছে। সেখানে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে মিষ্টি আজান শেষে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই মন্দিরে শোনা যায় উলুধ্বনি! চলে পূজা-অর্চনার অনুষ্ঠানিকতা। এমনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন বহন করছে লালমনিরহাট শহরের শতবর্ষী মসজিদ ও মন্দির।

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের রাজনীতির সাধনার মূলে অন্যতম আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদ। কলকাতায় অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৪৬ সা‌লে যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হ‌য়ে‌ছিল, তখন তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের দাঙ্গা বিরোধী তৎপরতায় নি‌য়ো‌জিত ছিলেন। তাছাড়া তখন শে‌রে বাংলা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এদেশে গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার একজন সমর্থক। পরে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি পরিবর্জনের লক্ষ্যে মুসলিম লীগ‌কে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও প‌রে আওয়ামী লী‌গে পরিবর্তন করেন। এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগ‌কে একটা অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করা।

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষের মিলিত রক্তস্রোতে তৈরি হয় আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। তাঁর মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা হলো প্রত্যেকের স্ব-স্ব ধর্ম পালন করার অধিকার। রাষ্ট্রের ব্যাপারে ধর্ম কোনো হস্তক্ষেপ করবে না, আর ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র থাকবে নির্লিপ্ত। তিনি বলেছিলেন, “সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। (বঙ্গবন্ধু, রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে প্রদত্ত ভাষণ, ৯ মে ১৯৭২)

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হয়েছিল। তারপরে কেটে যায় ২১ বছর। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সাম্প্রদায়িকতা গ্রহণকাল শেষ হতে শুরু করে। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি ‘জিরো টলারেন্স নীতি’র সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর শাসনামলের সংঘটিত এ জাতীয় বিভিন্ন মামলা সুষ্ঠু বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুবিচার নিশ্চিত করেন। ফলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে আবার অতীতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।  

এখনও সেই গ্রহণকাল পুরোপুরি কেটে যায়নি। সুযোগ পেলে এ অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। তবে সরকারের সময়োচিত বলিষ্ঠ পদক্ষেপে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কিছু কর্মী-সমর্থক এ বারের হিন্দু ধর্মীয় পবিত্র শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরান শরীফকে অবমাননার অভিযোগ তুলে কুমিল্লা জেলায় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনার জেরে ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও রংপুরের পূজা মণ্ডপ ও মন্দিরেও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। কিন্তু সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাশকতামূলক এ ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে। এ সকল ঘটনা ঔ সকল জেলাসমূহে মামলা দায়ের করা হয়েছে, এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে বেশ কিছু দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তারও করেছে।

ধর্ম হলো ধর্মীয় বিধানে বিশ্বাস, আনুগত্য, রীতিনীতি এবং কর্ম। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী। এ ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল কোরানের দ্বিতীয় সূরা ‘আল বাকারা’র ২৫৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘ধর্মের ব্যাপারে কোন জোরজবরদস্তি নেই’। ১০৯ নং সূরা ‘আল কাফিরূন’ এর ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়াদ্বীন’; অর্থাৎ, যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। পবিত্র আল কোরানের নির্দেশ অমান্য করে কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পক্ষে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। সুসানে আবু দাউদের ৫১২৩ নং হাদিসে বলা হয়েছে, “যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে, সংগ্রাম করে এবং জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের দলভূক্ত নয়”।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামিন। রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তাঁর কাছে সমান।” (বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণ, ১৯৭৪) বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত বাঙালি আজও তাই অসাম্প্রদায়িকতার অনন্য প্রতীক। ধর্ম ও বর্ণের উর্ধ্বে মানবতাবাদী এক প্রগতিশীল জাতি। কবির ভাষায়-

“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! (কাজী নজরুল ইসলাম, কাণ্ডারী হুশিয়ার!)