‘ধর্ষণ কোনো আধুনিক ব্যাপার নয়, এবং বিশেষ কোনো সমাজে সীমাবদ্ধ নয়। তবে কোনো কোনো সমাজ বিশেষভাবে ধর্ষণপ্রবণ, আর কোনো কোনো সমাজ অনেকটা ধর্ষণমুক্ত; যদিও সম্পূর্ণ ধর্ষণমুক্ত সমাজ ও সময় কখনই ছিল না, এখনো নেই।… পৃথিবীতে পৌরাণিক কাল আর নেই, দেবতারা আর ধর্ষণ করে না; তবে দেবতাদের স্থান নিয়েছে আজ পুরুষেরা; প্রায় অবাধ ধর্ষণ চলছে আজ পৃথিবী জুড়ে। ধর্ষণ আজ দেখা দিয়েছে মারাত্মক মড়করূপে;- আমেরিকার মতো শিল্পোন্নত সমাজে যেমন চলছে ধর্ষণ, তেমনি চলছে বাঙলাদেশের মতো অনুন্নত সমাজে। বাঙলাদেশ এখন সবচেয়ে ধর্ষণপ্রবণ সমাজের একটি; মনে হচ্ছে পৌরাণিক দেবতারা আর ঋষিরা দলবেধে জন্মলাভ করেছে বাঙলাদেশে।’ (হুমায়ুন আজাদ)
সমাজে কোনো মানুষ যেমন ধর্ষক হয়ে জন্ম গ্রহণ করে না, তেমনিভাবে হঠাৎ করে একজন মানুষ ধর্ষকের ভূমিকায় নামতে পারে না। শুধু ধর্ষকাম, রতিসম্ভোগ ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়। এর পেছনে দীর্ঘ পারিবারিক, মনোঃসামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাস থাকে যার সূত্রপাত ঘটে ছেলেবেলায়। এ পৃথিবীটা পুরুষতান্ত্রিক, পুরুষশাষিত সমাজে ভরপুর, তাই ধর্ষণে পুরুষরাই অগ্রগামী। তবে, নারী কর্তৃক ধর্ষণ কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক সমাজে মেয়েরাও পুরুষকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে, জোর করে নারী সমকামিতায় লিপ্ত হয়। ধর্ষণ কেবল যৌনসম্ভোগ হলে তিন বছরের মেয়ে, পয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিত হত না। ধর্ষণ শুধু নারীর দেহপ্রাপ্তি হলে নিরীহ পশুপাখিরাও মানুষের ধর্ষণের স্বীকার হতো না। যে ধর্ষণ করবে সে বোরকা ছিঁড়েও ধর্ষণ করবে, লোহার অন্তর্বাসও তাদের ঠেকাতে পারবে না। ধর্মের দোহাই দিয়ে বাসনা দমন করা যায়, নিবারণ করা যায় না। জাগ্রত অতৃপ্ত বাসনা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো, কারো কারো জীবনে সে কোনদিনও অগ্নুৎপাত ঘটায় না, আবার কারো জীবনে সে হঠাৎ করে লাভা উদগীরণ করে দেয়। নারীবিহীন জীবন হলেও ধর্ষণের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় না, কারাগারে পুরুষ পুরুষকে ধর্ষণ করে। লিঙ্গবিহীন হলেই ধর্ষণের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় না, বৃহন্নলারাও ধর্ষণ করে, ধর্ষিত হয়। জ্বালামুখ না থাকলে অগ্নুৎপাতের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় না, বিষ্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনাও থাকে।
ধর্ষণের সুখানুভব শুরু হয় গ্রাম্য পত্রিকাওয়ালাদের কাছ থেকে। কৈশোরে ঐ সব পত্রিকা-সাময়িকী খুঁজে খুঁজে ধর্ষণের রমনীয় ঘটনাপ্রবাহ পড়ার একটা মজা আছে। তারপর শকুনীর চোখ দিয়ে ধর্ষিত শবদেহের ছবি (বর্তমানে প্রতিকী ছবি ব্যবহার করা হয়) খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। অর্ধ-নগ্ন দেহের রঙিন ছবিটার উপড়ে লেপ্টে থাকা সামান্য কাপড়টুকুও সরাতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে পাতাটাই ছিঁড়ে ফেলা। মৃত ধর্ষিতার ছবিরও পুনঃপুনঃ ধর্ষিত হবার ক্ষমতা আছে … উরুতে উরু চেপে কেবলই উষ্ণতার অনুভব।
বয়োঃপ্রাপ্তিকালে পত্রিকার অপূর্ণতা পূরণ হয় সিনেমায়। কামজ ধর্ষণের কামোদ্দীপক নিবারণ- কামকেলি। মনে পড়ে, এ সব দৃশ্য বার বার দেখার জন্য একই সিনেমা লোকজন কয়েকবার দেখত। শপথ করে বলতে পারি, সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে, প্রতিবাদের দৃষ্টি দিয়ে কোনোদিনও কেউ ধর্ষণের দৃশ্য দেখতো না, দেখতো কামাতুর দৃষ্টিতে নিষ্পলক নয়নে। ক্যামেরা যেখানে যেখানে দেখাতো, যা যা দেখাতে চাইতো, সেটা তো তারা দেখতোই, বরং যা কোনভাবে ক্যামেরায় আড়াল করা হত তাও দেখার জন্য তাদের মনটা আঁকুপাঁকু করতো। বন্ধুর কাছে ঐ দৃশ্যটি বর্ণনার সময় প্রশ্নে প্রশ্নে বলার গতি শ্লথ হয়ে যেত…মদন-রতির রমনকাহনে পৌরুষের নিভৃত মর্দন। পুরুষত্বের আরো স্বপ্ন দিয়েছিল এক টিকিটের দুটি ছবি, নির্জনে বিসর্জনের স্বাদ দিতে চেয়েছিল নিশুথি রাতের নীল ছবি। না, ধর্মের দেবী এ বিসর্জন মেনে নেয় না। জলন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে সে বারংবার কুসংস্কারের কুলুপ এঁটে দেয়। মুঠোভর্তি লাভার মধ্যে টুপটাপ ঝরে পড়তো প্রায়শ্চিত্তের উষ্ণ অশ্রু।
আমাদের জীবনে যৌনতা কখনো শিক্ষা হয়ে ধরা দেয়নি, নারী কখনো মানসী হয়ে ওঠেনি। যৌনাচার কখনো সভ্যতা রূপে আসেনি, নারী কখনো সঙ্গী হয়ে ওঠেনি। পুরুষ নারীদেরকে যৌনসঙ্গী মেনে নিয়েছে, জীবনসঙ্গী নয়। সৃষ্টির আদি থেকে নারী-পুরুষের মাঝে লৈঙ্গিক সম্পর্ক আছে, মানুষের সম্পর্ক ক্ষণে ক্ষণে কালে কালে ভেঙে পড়েছে বারংবার। যেভাবে ধীরে ধীরে একটি জৈবিক পুংলিঙ্গ সমাজে বেড়ে ওঠে সেভাবে দণ্ডধারীর মনুষত্ব বেড়ে উঠছে না। জৈবিক পুংলিঙ্গ কোনো মায়ের সন্তান নয়, কামজ এক পুরুষ; ও কোনো বোনের ভাই নয়, লোলুপ এক পুরুষ; কোনো সীতার স্বামী নয়, লৈঙ্গিক এক পুরুষ; কোনো মেয়ের পিতা নয়, লোলাঙ্গী এক পুরুষ। এ পুরুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ নয়, মানুষের খোলশে পুরুষ জীব। যৌনতা এর ধর্ম আর ধর্ম রক্ষার্থে ধর্ষণ করা এর জৈবিক অধিকার। এরা মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা চায় না, নারী চায়- যোনিসর্বস্ব রক্তমাংশের একজন নারী। ইদানীং মনে হচ্ছে গরু–ছাগল-মুরগীর মতো অন্যান্য স্ত্রী বাচক প্রাণি হলেও চলে। মনে হচ্ছে পশুপাখিদেরও হিজাব পরিধানের সময় এসেছে।
সমাজের প্রতিটি জৈবিক পুংলিঙ্গ ক্রমাগত উত্তেজিত হচ্ছে। মণকে মণ ইয়াবা উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, ফুটপাতের ‘ধনন্তরী’র মতো মোটা-তাজাকরণের নামী-বেনামী বিভিন্ন যৌন উত্তেজক ওষুধ/পানীয় বা তাদের বিজ্ঞাপন উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, “ভানুসিংহ”রা পর্নের প্রতিটি কিলোবাইটে মুঠোয় মুঠোয় ছড়িয়ে দিচ্ছে উত্তেজনা। উত্তেজনা ছড়াচ্ছে আধুনিকতা, উত্তেজনা বাড়াচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। সুরার বীণায় সুরের মাতাল ঝংকার অসুরের মতো দণ্ডের মুণ্ডে সদাই ওঙ্কার-ডঙ্কার নৃত্য করে চলেছে। রাজপুত্র বা রাস্তার পুত্র, বয়স পনের কি পঞ্চান্ন- সবাই উত্তেজিত, কিন্তু প্রশমিত নয় কারণ উত্তেজিত হবার ক্ষমতা থাকলেও সবার সমান প্রশমিত হবার ক্ষমতা বা সুযোগ থাকে না। তাই ঘরের কোনে, বাস/ট্রেনের ভীড়ে, রেস্তোরার আলো-আঁধারিতে, নিভৃত শৌচাগারে, লিটনের ফ্লাটে, পার্কের নির্জনে, রিক্সায়, সিএনজিতে, হিউম্যান হলারে, মাইক্রোবাসে, ট্রাকে, বাসে, নৌকায়, পাটক্ষেতে, পাঠশালায়- যে যেখানে পারছে সেখানেই ঘর্ষণে ঘর্ষণে বর্ষণের স্পৃহা প্রশমণ করার চেষ্টা করছে। অন্যেরা যার জন্য যা করে, ধর্ষকেরাও তাই করে। তবে অন্যেরা সেভাবে করে ধর্ষকেরা সবটুকু ঠিক সেভাবে করে না। ওদের কাছে সঙ্গীতে সঙ্গীতে মিলনে সঙ্গম হয় না, পৌরুষের অনাকাঙ্খিত প্রবেশের নাম সঙ্গম।
যৌনতা মানব জীবনের চালিকা শক্তি, যৌনাচার পরম ধর্ম। যৌনাচারের বিকৃত রুচির নাম, সহিংসতার নাম যৌন অত্যাচার। এদের একটি সভ্যতা আর একটি অসভ্যতা। ধর্ষণের বিরুদ্ধে লেখালেখি ধর্ষণ বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারীদের সোচ্চার হবার সাহস, উদ্দীপনা যোগায় (গারো নারী ধর্ষণের ঘটনা ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলী এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ বিষয়ে বিডিনিউজ২৪.কমের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য।), তবে এভাবে ধর্ষককে নিবৃত্ত করা যাবে বলে মনে হয় না। আইন করে ও আইনের কঠোর প্রয়োগ করে ধর্ষণকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, বন্ধ করা যাবে না। মনুষ্য চেতনার যে স্তরে মানুষ ধর্ষণে প্রবৃত্ত হয় সে স্তরে কোনো নীতিবোধ কাজ করে না, কোনো ধর্মের দোহাই চলে না, কোনো আইনের ভয়ও নেই সেখানে। আমরা যৌনাচারের উর্ধ্বে কোনো অতিমানব নই, নপুংসকের মতো যৌনাচারের নিম্নেও নই। আমরা স্বাভাবিক মানুষ, আমাদের যৌনতা অস্বীকারের কোন উপায় নেই। অসুস্থ যৌন অত্যাচার প্রতিরোধে সুস্থ যৌনাচারকেই অধিক প্রাধান্য দিতে হবে- নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে; যৌন উত্তেজক ওষুধ/মাদক/পানীয়ের অবাধ বিচরণ রুখতে হবে; যৌন আবেদনমূলক যেকোনো ধরণের শিল্প-কলা-সাহিত্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; অবাধ ইন্টারনেটের যুগে যতটা সম্ভব পর্ন ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে, মোবাইলের মাধ্যমে পর্ন যেন সবার হাতে হাতে না পৌঁছাতে পারে সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখতে হবে। সন্তানদের জীবনে সুস্থ যৌনাচার শিক্ষার প্রথম স্তরে পরিবার, দ্বিতীয় স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তৃতীয় স্তরে সমাজ, চতুর্থ স্তরে মিডিয়া ও সর্বশেষ স্তরে রাষ্ট্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
যতদিন সমাজে যৌনাচারকে একটি স্বাভাবিক জৈবিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না ততদিন পর্যন্ত অসুস্থ বা বিকৃত রুচির হলেও যৌনতাড়িত মানুষ যৌন উত্তেজনার বশে জৈবিক চাহিদা নিবারণের জন্য বার বার ধর্ষণ করবে- দণ্ডকারণ্যের দণ্ডী, দণ্ডাঘাতের ফলে হবে দণ্ডিত।
প্রথম প্রকাশকাল– ১ জুন ২০১৫
সম্পর্কিত অন্যান্য ব্লগ