মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা- লালনগীতির ব্যাখ্যা।
”মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা
নিগম বিচারে সত্য তাই গেলো জানা ॥”
লালনগীতির ব্যাখ্যা
এ গানটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো গানটিতে দুই বার ‘নিগম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই নিগম তন্ত্র বুঝলে গানটির মূল অর্থ বুঝতে সুবিধে হয়। এ জন্য হিন্দুধর্মের তন্ত্রশাস্ত্র সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকার।
তন্ত্র ও মন্ত্রের সমন্বয় তন্ত্রশাস্ত্র। সহজ কথায়, যে শাস্ত্রানুযায়ী সাধন করলে জীবের মোক্ষ বা মুক্তি লাভ হয় তাকে তন্ত্রশাস্ত্র বলে।
আগম ও নিগম দুটি তন্ত্রশাস্ত্র। মহাদেব শিব ও তাঁর স্ত্রী পার্বতীর (বা দেবী দুর্গা) পরস্পরের প্রশ্নোত্তরের কথোপকথন নিয়ে রচিত দুটি তন্ত্রশাস্ত্র আগম ও নিগম। এখানে পার্বতীর প্রশ্ন সংকলকে ‘নিগম’ আর মহাদেব শিবের উত্তরকে ‘আগম’ বলে। তবে, কতিপয় তান্ত্রিক গ্রন্থকারদের মতে, দক্ষিণাচারের (বেদোক্তবিধি অনুসারী) সাধনশাস্ত্রের নাম ‘আগম’ এবং বামাচার (বেদবিরোধী) সম্প্রদায়ের সাধনশাস্ত্রের নাম ‘নিগম’।
আবার, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বেদ ‘আগম’ ও ‘নিগম’ নামেও পরিচিত। এখানে ‘আগম’ শব্দের অর্থ ‘যা ঐতিহ্য রূপে আমাদের কাছে এসেছে’ এবং ‘নিগম’ শব্দের অর্থ হল ‘যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে’।
চলুন এবার গানের চরণে
“মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা
নিগম বিচারে সত্য তাই গেলো জানা ॥”
লালনগীতির ব্যাখ্যা- এ গানে লালন তান্ত্রিকদের সাধনতত্ত্বে নারীর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। নিগম তন্ত্রশাস্ত্র থেকে জানা যায়, মায়ের সাধনা করলে সাধকেরা বাপের সান্নিধ্য পাবে।
পুরুষ পরওয়ার দিগার
অঙ্গে আছে প্রকৃতি তার
প্রকৃতি, প্রকৃতি সংসার
সৃষ্টি সবজনা।।
লালনগীতির ব্যাখ্যা- অর্ধনারীশ্বর (অর্ধেক নারী যে ইশ্বর) শিবের একটি রূপ। এ রূপে শিবের দেহের অর্ধেক পার্বতী। শাক্তধর্ম মতে, পার্বতী জগৎ-সংসার সৃষ্টি করেন। আবার, সাংখ্য দর্শন মতে, পৃথিবীর মাত্র দুটি প্রাথমিক নীতি আছে- পুরুষ (মহাজাগতিক সত্তা) ও প্রকৃতি (মূল বা প্রকৃত রূপ)।
নিগম খবর নাহি জেনে
কে বা সে মায়েরে চেনে
যাহারে দিন দুনিয়া
দিলেন রব্বানা।।
লালনগীতির ব্যাখ্যা- বাপে যে মায়ের উপর দিন-দুনিয়ার ভার দিলেন, নিগমতন্ত্র ছাড়া সে মাকে চেনার কোনো উপায় নেই।
ডিম্বু মধ্যে কে বা ছিল
বাহির হইয়া কারে দেখিল
লালন কয় সে ভেদ যে পেল
ঘুচলো দিনকানা।।
লালনগীতির ব্যাখ্যা- ঋগ্বেদ, শতপথ ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ ও মনুস্মৃতি মতে, বৈদিক দেবতা প্রজাপতি (ব্রহ্মা, নিরঞ্জন) হিরণ্যগর্ভ (বা মহাজাগতিক সোনার ডিম) থেকে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পরে তিনি শক্তি দেবীকে দেখতে পেয়েছিলেন। এসব নিগম তত্ত্ব যে সাধক জানতে পারবে সে সফলকাম হতে পারবে।
লালনগীতির ব্যাখ্যাসহ পুরো গানটির ভিডিও দেখুন-
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – তিন পাগলের মেলা গানের ব্যাখ্যা
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে গানের ব্যাখ্যা
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – এক ফুলে চার রং ধরেছে গানের ব্যাখ্যা
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – ধরো চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে
শব্দার্থ-
* মা – শক্তি, পার্বতী, দুর্গা
* ভজা – উপাসনা করা
* বাপ- শিব, ইশ্বর
* বাপের ঠিকানা -কৈলাস
* পরওয়ারদিগার – ফার্সি শব্দ। অর্থ ‘পালনকারী’ বা ‘লালনকারী’। সচরাচর ‘ইশ্বর”-কে বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
* প্রকৃতি – শক্তি, পার্বতী, দুর্গা
* দিন – দ্বীন
* ডিম্বু- ডিম