“তিন পাগলে হলো মেলা নদে’ এসে
তোরা কেউ যাস নে ও পাগলের কাছে ।।”
পাগল কেন?
কারা সেই পাগল?
নদে’ কোথায়?
উপরের তিনটি প্রশ্নে উত্তর জানলেই লালনের এ গানটি বোঝা যায়?
পাগল কেন?
এই তিন পাগল সবাই শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত – হরি পাগল। তাই লালন এদেরকে সবাইকে ‘পাগল’ বলেছেন।
কারা সেই পাগল?
লালন নিজেই গানের শেষে সেই তিন পাগলের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন:
“ও সে চৈতে নিতে অদ্বে পাগল
নাম ধরেছে।”
এখানে ‘চৈতে’ মানে শ্রীচৈতন্যদেব, আর ‘নিতে’ ও ‘অদ্বে’ সেই চৈতন্যের দুই প্রধান পার্ষদ- নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য।
তিন পাগলে কোথায় মেলা করেছিল?
তিন পাগলে ‘নদে’ মানে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী ভারতের পশ্চিম বাংলার ‘নদিয়া’ (পূর্বনাম নবদ্বীপ) জেলায় মেলা জমিয়েছিল।
নদিয়া – ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় নদিয়া হিন্দু ধর্মালম্বিদের জন্য একটি তীর্থস্থান। বাংলার সেনরাজা বল্লাল সেন নদিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম সেনাপতি বখতিয়ার খলজী ১২০৪ সালে বাংলা বিজয় করার আগে নদিয়া বাংলার রাজধানী ছিল।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম – গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম হিন্দু বৈষ্ণবধর্মের একটি উপসম্প্রদায়। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে পূর্বভারতে চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬ – ১৫৩৪) এই ধর্মান্দোলনের সূত্রপাত করেন। এ ধর্মমতে, পঞ্চদশ শতকে পৃথিবীতে আবির্ভুত ঈশ্বরের (কৃষ্ণ) পাঁচটি অবতার হলেন পঞ্চতত্ত্ব। এরা হলেন চৈতন্য মহাপ্রভু, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য, গদাধর পণ্ডিত ও শ্রীনিবাস ঠাকুর। এঁদের দ্বারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত হরে কৃষ্ণ মন্ত্র ছড়িয়ে পরে।
প্রধান পাগল- শ্রীচৈতন্যদেব
নদিয়ার শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৪) লোকপ্রিয় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী, ধর্মগুরু মহাপুরুষ এবং সমাজসংস্কারক। তিনি ‘চৈতন্য মহাপ্রভু’, ‘গৌরাঙ্গ’, ‘গৌরচন্দ্র’ বা ‘নিমাই’ নামেও পরিচিত।
বাকী দুই পাগল- নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত আচার্য
চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান ও অন্তরঙ্গ সঙ্গী নিত্যানন্দ প্রভু (১৪৭৪-১৫৪০)। তিনি ‘নিতাই’ নামে পরিচিত। শ্রীচৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ প্রভুকে একত্রে ‘নিমাই-নিতাই’ বা ‘গৌর-নিতাই’ বলে।
অদ্বৈত আচার্য বা অদ্বৈতাচার্য গোস্বামী (১৪৩৪-১৫৫৯) একজন বৈষ্ণব দার্শনিক এবং ধর্মবেত্তা।
”তিন পাগলে হলো মেলা নদে’ এসে
তোরা কেউ যাস নে ও পাগলের কাছে ।।”
গানটিতে একটি ব্যাঙ্গাত্মক সুর আছে। আপাত মনে হচ্ছে, লালন নদিয়ার ঐ তিন পাগলের কাছে যেতে নিষেধ করছেন। কিন্তু তিনি আসলে ওঁদের কাছে যেতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
”একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে
দৌড়ে গিয়ে;
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে
ধূলার মাঝে।।”
গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে পঞ্চতত্ত্ব প্রধান শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথাবিরুদ্ধ ছিলেন।
এই পঞ্চতত্ত্বের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ‘হরে কৃষ্ণ’ মন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে।
”একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলা ফেলা
করঙ্গ সে;
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি
বুঝবি শেষে ।।”
গৌড়ীয় বৈষ্ণবের পঞ্চতত্ত্বরা সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তাঁদের কাছে কেউ গেলে, সেও ওদের মতো (হরি) পাগল হবে। তাই লালন ব্যাঙ্গ করে বলছেন, ‘তোরা কেউ যাস নে ও পাগলের কাছে।’
”পাগলের নামটি এমন
বলিতে অধীন লালন
হয় তরাসে
ও সে চৈতে নিতে অদ্বে পাগল
নাম ধরেছে ।।”
লালন ঐ সব পাগলের এতটাই ভক্ত যে, তাঁদের নাম মুখে আনতেও সে ভয় পায়। অবশেষে লালন তাঁদের পরিচয় বলে দিলেন।
গানটির ভিডিও ও ইংরেজি অনুবাদ দেখতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন-
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে গানের ব্যাখ্যা
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – এক ফুলে চার রং ধরেছে গানের ব্যাখ্যা
- লালনগীতির ব্যাখ্যা – ধরো চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে