শুরুতে আমি তিনটি গানের কয়েকটি করে লাইন বলবো। আমরা সবাই এই গানগুলো পছন্দ করি, অসম্ভব পছন্দ করি। আজ সেই সব অমর গানের স্রষ্টার কথা বলবো।
এক.
আমার সোয়া (সোনার) চান পাখি
আমি ডাকিতেছি (ডাকছি) তোরে, ঘুমাইছ নাকি।।
দুই.
মানুষ ধর, মানুষ ভজ
শুন বলিরে পাগল মন।
মানুষের ভিতরে মানুষ
করিতেছে বিরাজন।।
তিন.
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়িয়াছ সাই।।
প্রথম দুটি গান আমরা শুনেছি বাউল শিল্পী বারী সিদ্দীকির কণ্ঠে। আর তৃতীয় গানটি গেয়েছেন মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম। কিন্তু আমরা খুব কম মানুষই জানি এই তিনটি অসাধারণ গান একজনের লেখা। বরেণ্য এ বাউল সাধকের নাম রশিদ উদ্দীন (১৮৮৯ -১৯৬৪)।
নেত্রকোণা পৌরসভাধীন বাহিরচাপড়া গ্রামে রশিদ উদ্দীনের জন্ম হয়েছিল। তিনি একজন সিদ্ধ বা খাঁটি বাউল কবি। তবে তিনি মূলত সঙ্গীত আশ্রয়ী বাউল কবি। সেইসাথে তিনি লোকজ দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, সাম্যবাদী মরমি সাধক।
বৃহত্তর ময়মনসিংহে তথা নেত্রকোণা অঞ্চলে বাউল গানকে বলা হয় বাউলা গান। আর এই বাউল গানের ধারায় নেত্রকোণা অঞ্চলে সর্বপ্রথম নতুন সংযোজন হলো ‘মালজোড়া বাউল গান’। মালজোড়া বাউল গান প্রতিযোগিতামূলক বাউল গান। এতে একে অপরকে কটাক্ষ করে কথা ও গানের মারপ্যাঁচে আটকিয়ে দর্শকদের সুস্থ বিনোদন দেয়া হয়। এই মালজোড়া বাউল গানের স্রষ্টা হলেন বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন।
বাউলদের গান কখনও যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। অনেক সময় ঠিকমতো স্বীকৃতিও পায়নি। মুখে মুখে রচিত হয়ে জনে জনে ছড়িয়ে পড়েছে। এক সময়ে হারিয়ে গেছে আসল গীতিকারের নাম। আধুনিককালে অনেকে আবার সেই সব বাউলদের গানকে নিজেদের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেছে। এমনকি আব্দুল আলীমের মতো গুণী শিল্পীও “এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া” গানটিকে “সংগ্রহ” বলে চালিয়ে দিয়েছেন।
এ কালে চুরি শব্দের আধুনিক রূপ “সংগৃহীত”। মানুষ মানুষের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চায় না। অন্যের লেখা চুরি করে জেনে শুনে সযত্নে “সংগৃহীত” বলে; তবু, লেখকের নাম বলতে চায় না।
বাউল সাধক নাম রশিদ উদ্দীনের শিষ্যরা বিখ্যাত। এদের মধ্যে বাউল শাহ আবদুল করিম, বাউল জালাল উদ্দীন খাঁ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এমনকি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির লেংটা পীরও তাঁর শিষ্য ছিল। রশিদ উদ্দীনের সমসাময়িক আরেক বিখ্যাত বাউল সাধক উকিল মুন্সী। রশিদ উদ্দীন ও উকিল মুন্সী – এই দুই বাউল সাধকের গান সবচেয়ে বেশি গেয়েছেন বাউল বারী সিদ্দীকি।