সংস্কৃতি

আমার ধারণা ছিল যে ভূত-প্রেতাত্মা শুধু বাংলাদেশ, ভারতের গ্রামাঞ্চলের মেধাস্বত্ত্ব। এখন তো দেখি ইউরোপ-আমেরিকার লোকজনও কম কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। এদের বিশ্বাসে ভূত, ভ&zwj;্যাম্পায়ার, ডাকিনী, জমবি (zombie) কোনোটারই কোনো ঘাটতি নেই। এরা ভূতে যে শুধু বিশ্বাস করে তা নয়, রীতিমত ভূতের পূজা-অর্চনা করে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার ব&zwj;্যবসা করছে। পাশ্চাত&zwj;্যে ভূতের এ পূজা, এ ব&zwj;্যবসার নাম হ&zwj;্যালোউইন (Halloween)। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে যুক্তরাজ&zwj;্য, আয়ারল&zwj;্যান্ডে হ&zwj;্যালোউইনের সূত্রপাত ঘটে। সে সময়ে ঐ অঞ্চলের আদিবাসীদেরকে বলা হতো কেল্টস (Celts)। পহেলা নভেম্বর ছিল কেল্টসদের নববর্ষ। তারা বিশ্বাস করতো, নববর্ষের আগের রাতে দুষ্টু আত্মারা সক্রিয় হয়ে ওঠে আর তারা পৃথিবীতে তাণ্ডব শুরু করে। পুরোহিতদের (বা ‘ড্রুইদ’দের) পরামর্শে কেল্টসরা এ রাতে অশান্ত আত্মাদেরকে শান্ত ও দমিত করার জন&zwj;্য স্থানে স্থানে খড়ের আগুন (bonfire) জ্বালিয়ে রাখতো, পশু বলি দিতো, নিজেরা ভূতের সাজপোশাকে আত্মগোপন করতো আর ঘরের সামনে ভূতের মূর্তি বানিয়ে সেখানে মিষ্টি মিঠাই সাজিয়ে রাখতো। তারা মনে করতো যদি তারা ভূতের সাজপোশাকে ঘুরে বেড়ায়, তবে ভূতেরা তাদেরকে চিনতে পারবে না আর ঘরের সামনে খাবার পেলে খাবারের খোঁজে তারা ঘরে ঢুকবে না। কেল্টসদের এ ভূত পূজার নাম ছিল ‘সোইন’ (Samhain)। খ্রিষ্টীয় ৪৩ সালে প&zwj;্যাগান কেল্টসরা ক&zwj;্যাথলিক রোমান সাম্রাজ&zwj;্যের অন্তুর্ভূক্ত হয়। অষ্টম শতকে রোমানরা পহেলা নভেম্বরে একই সাথে ক&zwj;্যাথলিসিজমের ‘ঋষি দিবস’ (All-hallows/All Saints’ Day) ও সৈনিকদের স্মরণে ‘শহীদ দিবস’ উদযাপন শুরু করে; এরই সূত্র ধরে তারা কেল্টসদের ৩১ অক্টোবরের ‘সোইন’ উৎসবকে ‘All-hallows eve’ নামে ঐ দুই দিবসের সাথে একীভূত করে নেয়। All-hallows পরবর্তীতে হ&zwj;্যালোউইন নামে পরিচিতি লাভ করে। রোমানরা ফল ও বৃক্ষের ‘পামোনা’ (Pamona) দেবীর পূজায় ‘অ্যাপল ববিং’ (apple bobbing) করতো। পরে হ&zwj;্যালোউইনে উৎসবেও ‘অ্যাপল ববিং’ শুরু হয়। ‘অ্যাপল ববিং’ অনেকটা আমাদের দেশে বাচ্চাদের বিস্কিট দৌড়ের মতো, তবে এখানে পানি ভর্তি বড় গামলার মধ&zwj;্য আপেল ভাসতো আর লোকজনকে মুখ দিয়ে কামড়ে সেটা তুলতে হতো। সময়ের সাথে সাথে হ&zwj;্যালোউইন উৎযাপন ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা পেতে থাকে। এ উৎসবে যোগ হয় ‘জ&zwj;্যাক ও ল&zwj;্যান্টার্ন’ (Jack O’ lanterns) বা ‘উইল-ও-দ&zwj;্য-উইপস’ (will-o’-the-wisp), যাকে বাংলায় বলা যায় ‘আলেয়ার আলো’। জ&zwj;্যাককে (Jack) নিয়ে মজার পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে- জ&zwj;্যাক ছিল ভয়াবহ দুষ্টু প্রকৃতির লোক। এমনকি সে একবার শয়তানকেও ধোঁকা দিয়েছিল। ফলে, শয়তান তার আত্মাকে না নেয়ার অঙ্গীকার করে। মৃত&zwj;্যুর পরে জ&zwj;্যাক স্বর্গে ঢুকতে ব&zwj;্যর্থ হয়ে নরকের দ্বারে ঘুরছিল। কিন্তু, শয়তান অঙ্গীকারের কারণে তাকে নরকেও নিতে পারেনি। কোনো উপয়ান্তর না পেয়ে অন&zwj;্য সব দুরাত্মাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে ও অন্ধকার মৃত&zwj;্যুপুরীতে ঘুরে বেড়ানোর জন&zwj;্য শয়তান তাকে এক খণ্ড আগুন উপহার দেয়। আগুন রাখার অন&zwj;্য কোনো জায়গা না পেয়ে জ&zwj;্যাক তার শালগমের খোলের মধ&zwj;্যে আগুনখণ্ডটি রেখে মৃত&zwj;্যুপুরীরে ঘুরে বেড়াতো। তাই হ&zwj;্যালোউইনের রাতে ভূতকে দূরে রাখতে লোকজন ঘরের সামনে ‘জ&zwj;্যাক ও ল&zwj;্যান্টার্ন’ বসিয়ে রাখতো, অর্থাৎ, শালগমের খোলের মধ&zwj;্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতো। শালগমের ল&zwj;্যান্টার্ন তৈরিতে কষ্ট ও দুষ্প্রাপ&zwj;্যতার কারণে ‘জ&zwj;্যাক ও ল&zwj;্যান্টার্ন’ তৈরিতে এখন কুমড়ো আবির্ভাব ঘটেছে। কেবল হ&zwj;্যালোউইনকে সামনে রেখে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে কয়েক বিলিয়ন কুমড়ো উৎপাদন করা হয়। কালের বিবর্তনে ‘অ্যাপল ববিং’য়ের পরিবর্তে হ&zwj;্যালোউইনের সাথে যে সংস্কৃতির যুক্ত হয় তার নাম ‘গোইং-অ্যা-সোলিং’ (going-a-souling)। এর সাথে মুসলমানদের শব-ই-বরাতের রাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রুটি-হালুয়া যোগাড়ের মিল রয়েছে। হ&zwj;্যালোউইনের রাতে লোকজন ভূতের সাজপোশাকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘সোল কেক’ (soul cakes) যোগাড় করতো আর সেই পরিবারের মৃতদের আত্মার শান্তির জন&zwj;্য প্রার্থনা করতো। হ&zwj;্যালোউইনের বাণিজ&zwj;্যিকীকরণের সূত্রপাত ঘটে আমেরিকায়। ১৮৪৬ সালে আয়ারল&zwj;্যান্ডে ‘আলু দুর্ভিক্ষে’র ফলে কয়েক হাজার আইরিশ আমেরিকায় পাড়ি জমায়। এদের হাত ধরে আমেরিকাতেও হ&zwj;্যালোউইন উৎসব শুরু হয়। যুগে যুগে হ&zwj;্যালোউইনে ভূতের সাজপোশাকে বাহারি পরিবর্তন ঘটলেও গত আড়াই হাজার বছর ধরে মুখোশ-পোশাক এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হিসেবেই টিকে আছে। তবে, বাণিজ&zwj;্যিকীকরণের সাথে আমেরিকায় এ উৎসবে যে দুটি পরিবর্তন ঘটে তাদের একটি ‘গোইং-অ্যা-সোলিং’য়ের পরিবর্তে ‘ট্রিক-অর-ট্রিট’ (trick-or-treat) সংস্কৃতি। খুব সহজ ভাবে বোঝাতে গেলে বলা যায়, ‘ট্রিক-অর-ট্রিট’ হলো সেভাবে চকলেট, ক&zwj;্যান্ডি বা ডলার আদায় করা যেভাবে আমাদের দেশে বেদেরা সাপের ভয় দেখিয়ে বা হিজড়ারা সাধারণ মানুষকে অপ্রস্তুত করে টাকা আদায় করে। অথবা, সেই সব ভিক্ষুকদের মতো ভিক্ষা করা যারা টাকা পেলে লম্বা করে দোয়া করে আর না পেলে গালিগালাজ করে; হকার্স মার্কেটের সেই সব দোকানিদের মতো ব&zwj;্যবহার করা যারা তাদের দামে জিনিসপত্র কিনে না ঠকলে আপনাকে অপমান করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। দ্বিতীয় পরিবর্তন হলো ‘সোল কেকে’র পরিবর্তে চকলেট, ক&zwj;্যান্ডির সন্নিবেশন। যুক্তরাষ্ট্রে এখন ইস্টার (Easter), বড়দিনের (Christmas) চেয়ে হ&zwj;্যালোউইনে বেশী চকলেট, ক&zwj;্যান্ডি বিক্রি হয়। আর মোট বেচাকেনায় বড়দিনের পরেই হ&zwj;্যালোউইনের অবস্থান। প্রতি বছর পাশ্চাত&zwj;্য ও প্রাচ&zwj;্য মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটি দেশে হ&zwj;্যালোউইন উদযাপিত হয়। প্রাচ&zwj;্যের দেশগুলোর মধ&zwj;্যে চীন, জাপান, দঃ কোরিয়া, হংকং, ফিলিপাইনস, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল&zwj;্যান্ডে হ&zwj;্যালোউইন উদযাপিত হয়। চীনে হ&zwj;্যালোউইন ‘তেং চেইহ’ (teng chieh), জাপানে ‘মাতসুরি’ বা ‘উরাবন’ (matsuri/urabon), হংকংয়ে ‘ইয়ে ল&zwj;্যান’ (yue lan), কোরিয়ায় ‘চুসক’ (chusok) আর সুইডেনে ‘ওল হেলগনো দ&zwj;্যাগ’ (all helgons dag) নামে পরিচিত। প্রথম প্রকাশকাল- ৩০ অক্টোবর ২০১৬ সম্পর্কিত অন্যান্য ব্লগ

হ্যালোউইন

সামবা নৃত্য

লও হে মা দিবস

এপ্রিল ফুল, তথ্যের ভুল?